অতিরিক্ত খরচ অভিভাবকদের ওপর চাপ তৈরি করছে
প্রাথমিকের তুলনায় মাধ্যমিকের খরচ তুলনামূলক বেশি
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা
রেজওয়ান বাপ্পী
চলছে জানুয়ারি মাস। শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। এক দিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ প্রতিনিয়িত বাড়ছে। এ অবস্থায় এক প্রকার টালমাটাল হয়ে পড়েছেন মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের অভিভাবকরা। এ যেনো ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা।’
মা, স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ভ্যানচালক মন্টু মিয়ার সংসার। এমনিতেই সংসারে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। এর ভেতর জানুয়ারি মাসের শুরুতেই দুই ছেলে-মেয়েকে মাদরাসায় ভর্তি করতে ৩ হাজার টাকা লেগেছে। মন্টু জানান, ভর্তির পাশাপাশি বই, খাতা, কলম, ডায়েরি বাবদ আরও দুই হাজার টাকা লেগেছে। দুজনের ড্রেস বানাতে খরচ হয়েছে ২০৫০ টাকা। প্রতি মাসে ছেলে-মেয়ের বেতন দিতে হবে ১৫০০ টাকা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখনও মেয়ের কিছু বই-খাতা কিনে দিতে পারিনি।’
দিনমজুর মিলন হোসেন বলেন, ‘পাঁচ সদস্যের সংসার আমার। মেয়েকে এবার তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করেছি। ভর্তি ফি সেশন চার্জসহ ১৫০০ টাকা দিতে হবে বলে স্কুল থেকে জানিয়েছে। খাতা-কলম বাবদ লেগেছে ৫০০, স্কুলব্যাগ ৫০০, জুতা ৬০০, স্কার্ফ কিনতে খরচ হয়েছে ২৫০ টাকা। এছাড়া প্রতিমাসে বেতন ৯০০ টাকা তো রয়েছেই। বর্তমানে হাতের যে অবস্থা তাতে ভর্তির জন্য স্কুল থেকে সময় নিয়েছি। তবে কবে, কিভাবে পরিশোধ করবো তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’
দশম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর অভিভাবক রেহেনা খাতুন বলেন, ছেলে আগে যে স্কুলে পড়াতাম সেখানে জানুয়ারি মাসে ভর্তিসহ ১২ হাজার ৬০০ টাকা নিচ্ছে। খরচ বেশি হওয়ায় এবার ছেলেকে অন্য স্কুলে দিয়েছি। এখানে ভর্তি ও সেশন চার্জ হিসেবে ৭৮২৬ (এক মাসের বেতনসহ) টাকা লেগেছে। প্রতি মাসে বেতন ৮৩০ টাকা।
তিনি আরও বলেন, উপায় নেই তাই ভর্তি করাতে বাধ্য হয়েছি। অন্যান্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২০-২২ হাজার টাকা পর্যন্ত লাগছে বলেও জানান তিনি।
শিক্ষার খরচ দিন দিন বাড়ছে, কমছে না। যেটার প্রয়োজন নেই সেটাও অভিভাবকদের উপর চাপানো হচ্ছে। কেনো প্রতি বছরই একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি হতে হবে? নিত্যপণ্যের দামে যখন একটি জাতি ভুগছে ঠিক তখনই অধিক শিক্ষা ব্যয়ে একটি জাতিকে ধ্বংসের পায়তারা করা হচ্ছে।
– হামিদুল হক শাহীন, সহকারী অধ্যাপক, এমএম কলেজ
মাহমুদ মুকুল নামে এক অভিভাবক বলেন, সন্তানের শিক্ষা ব্যয় এখন মধ্য পরিবারের খরচের অন্যতম প্রধান খাত। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি মোট সংসার খরচের ২০-২৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও শিক্ষার মাধ্যম ও স্তর অনুযায়ী এটি অনেক পরিবারের খাবারের ব্যয়কে ছাড়িয়ে যায়। ফলে কমাতে হচ্ছে খাদ্য, বিনোদন ও অন্যান্য চাহিদা।
বেসরকারি এক গবেষণা বলছে, বর্তমানে প্রায় ৫০ ভাগ শিক্ষার্থী বিভিন্ন স্তরে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ অভিভাবকদের দারিদ্রতা। শিক্ষা ব্যয় কম হলে ঝরে পড়ার হার অনেক কমতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অভিভাবকরা বলছেন, প্রতিবছরই কাগজের দাম যেমন বেড়েছে তেমনি টিউশন ফি, কোচিং ফি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত ভাড়া-সবই বেড়েছে। কিন্তু অভিভাবকদের আয় তেমন বাড়ছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করছেন তারা খুব একটা ভালো নেই। বাসা ভাড়াসহ নানা খাতে সংসারের ব্যয় রয়েছে, যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের বেতন, প্রাইভেট টিউটর-কোচিং ও সহায়ক বই বাবদ শিক্ষা ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে এই তিন খাতে প্রায় ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বেড়েছে। তবে প্রাথমিকের তুলনায় মাধ্যমিক পর্যায়ে খরচের হার তুলনামূলক বেশি। অতিরিক্ত এই খরচ অভিভাবকদের সীমিত আয়ের ওপর চাপ তৈরি করছে ক্রমাগতভাবে। শিক্ষা ব্যয় কমাতে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম।
সংগঠনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে অভিভাবকদের পক্ষে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সব জিনিসের দাম যে হারে বাড়ছে, সে অনুযায়ী তাদের আয় বাড়েনি। ফলে সংসারই তো চলছে না, বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ দেবে কীভাবে? তাই আমাদের দাবি হলো- শিক্ষা উপকরণ যেন সরকার সরবরাহ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক ফি বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার। কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ করে বিদ্যালয়েই সব পড়ানো হোক। আমরা অভিভাবকরা জিম্মি হয়ে গেছি সরকার আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের মাসিক বেতন বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। আর কোচিংয়ে বিষয় প্রতি খরচও একই হারে বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সহায়ক বইয়ে। এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া শিক্ষা উপকরণের এককালীন ইউনিফর্ম আর স্কুলব্যাগ এসবেরও দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত।
অস্বাভাবিক বেড়ে শিক্ষা উপকরণের দাম স্থিতিশীল :
যশোর শহরের রয়েল বুক ডিপো, জনতা লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন স্টেশনারি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর শিক্ষা উপকরণের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। তবে গত বছরে তিন থেকে চার দফায় দাম বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমানে ১২০ পৃষ্ঠার খাতা ৪৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে ছিল ৪০-৫০ টাকায়।
জানতে চাইলে হাসান বুক ডিপোর সেলসম্যান আল-আমিন দৈনিক কল্যাণকে বলেন, দাম যা বাড়ার আগে বেড়েছে। এ বছর সেভাবে দাম বাড়েনি। তবে অনেক পণ্যের দাম কোম্পানির পক্ষ থেকে বাড়ানো হলেও আগের দামে বিক্রি করতে হচ্ছে দোকানদারদের।
রয়েল বুক ডিপোর সেলসম্যান আল-আমিন দৈনিক কল্যাণকে বলেন, ‘আগে রাবার কেনা পড়তো ৩ টাকা। বিক্রি করতাম ৫ টাকায়। এখন কেনা পড়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা, বিক্রি করতে হচ্ছে আগের দামে। ৮৪ পৃষ্ঠার খাতার দামেও এই অবস্থা। আগে ২২ টাকা কিনতাম, বিক্রি করতাম ৩০ টাকায়। এখন কেনা ২৭ টাকায়, বিক্রি ৩০ টাকায়।’
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, শিক্ষা ব্যয় একটি জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষার খরচ দিন দিন বাড়ছে, কমছে না। বিষয়টি নিয়ে সবাই কষ্ট পাচ্ছে। যেটার প্রয়োজন নেই সেটাও অভিভাবকদের উপর চাপানো হচ্ছে। কেনো প্রতি বছরই একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি হতে হবে? নিত্যপণ্যের দামে যখন একটি জাতি ভুগছে ঠিক তখনই অধিক শিক্ষা ব্যয়ে একটি জাতিকে ধ্বংসের পায়তারা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানোয় নীতিমালা করা জরুরি। তাহলে শিক্ষার মান যেমন বজায় থাকবে তেমনি সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত হবে। যদি সেটি সম্ভব না হয় তাহলে প্রণোদনা দিয়ে হলেও সরকারকেই শিক্ষা ব্যয় কমাতে হবে।
তিনি বলেন, আগে দেখা যেতো পোর ফান্ডসহ সহযোগিতার নানা ফান্ড থাকতো। এখন সেগুলো নেই বললেই চলে। এ দিকেও সরকারকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।