দেশের শতভাগ মানুষ কৃষকের ওপর নির্ভরশীল। যে দেশের কৃষকরা রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে ফসল ফলিয়ে মানুষের মুখের অন্ন জোগায়, সে দেশের কৃষকরা পায় না কোন মর্যাদা, উৎপাদিত ফসলেরও কোন ন্যায্যমূল্য দেয়া হয় না।
লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল: আগামী এক বছরের মধ্যে ষাটোর্ধ- সব নাগরিকের জন্য অবসরকালীন সুবিধা বা পেনশন চালু করতে যাচ্ছে সরকার। যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কোটি কোটি সালাম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দের্শিত এই খবরটিকে সকলেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। বিশেষ করে আমরা যশোরের বাঘারপাড়ার গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত এলাকার ৬৪ টি কৃষি ক্লাবের হাজার হাজার কৃষক সবচেয়ে বেশি আনন্দিত ও গর্বিত । কারণ এই দাবিটা নিয়েই আমাদের প্রিয় কৃষক সংগঠক প্রয়াত আইয়ূব হোসেন ও আমরা প্রতিটি গ্রামের কৃষি ক্লাবের কৃষক নেতা বা কৃষক সংগঠকদের নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছিলাম।
আমাদের দাবিটা ছিল- বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আর এ দেশের সিংহভাগ মানুষ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। দেশের শতভাগ মানুষ কৃষকের ওপর নির্ভরশীল। যে দেশের কৃষকরা রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে ফসল ফলিয়ে মানুষের মুখের অন্ন জোগায়, সে দেশের কৃষকরা পায় না কোন মর্যাদা, উৎপাদিত ফসলেরও কোন ন্যায্যমূল্য দেয়া হয় না। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই কৃষকের ওপর ভর দিয়েই উচ্চপর্যায়ের যাবতীয় যা কিছু সম্পাদন হয়ে থাকে। দেশে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, যেকোন চাকরি শেষে তাদের পেনশন ভাতা, এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও ভাতা চালু হয়েছে। অথচ কৃষকের নামে কোন ভাতা চালু নেই। হয়তো অনেকে বলবেন যে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা তো কৃষকের মধ্যেই পেয়ে থাকে। কিন্তু না আমরা বলছি কৃষক পেনশন ভাতা চালু করতে। কারণ ষাটোর্দ্ধ বয়সী যেসব কৃষক তারা না পারে কোন চাষ কাজ করতে, না পারে অন্য কিছু করে জীবন রক্ষা করতে। তাই তাদের বেঁচে থাকতে একটা অবলম্বন দরকার। সব দিক বিবেচনাপূর্বক সরকারের কাছে আমাদের সবিনয় নিবেদন, এ দেশের কৃষকের পেনশন ভাতা চালু করা হোক। এই দাবিটা উঠে এসেছিল সম্প্রতি কৃষক প্রতিনিধিদের এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে। সেই কৃষক প্রতিনিধিদের গোলটেবিল বৈঠকের স্থানের পরিচয় একটু বিষদভাবেই দিতে হয়। কারণ সারা বাংলাদেশের একটা বৃহৎ কৃষক সংগঠন যার নাম গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার গাইদঘাট গ্রামে অবস্থিত এ অঞ্চলের ৬২ টি গ্রামের ৬৪ টি কৃষি ক্লাবের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র। কেন্দ্রটি ২০০১ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর তৎকালীন মহাপরিচাক ড. আব্দুর রাজ্জাক উদ্বোধন করেছিলেন। সারা বাংলাদেশের একটা বৃহৎ কৃষক সংগঠন, যার অভূতপূর্ব অবদান সারা দেশের কৃষক, কৃষিবিদ ও কৃষি বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাগণ একবাক্যে স্বীকার করেন। এই কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রটি এ অঞ্চলের ৬৪টি কৃষিক্লাবের নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় সংগঠন হিসাবে কাজ করে। এই কেন্দ্রের উদ্যোগে যশোরের গাইদঘাট গ্রামে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের কাজ শুরু হয়। যে কারণে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের মডেল এলাকা হিসাবে যশোর জেলা সারা বিশ্বের মধ্যে স্থান পায়। এই কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি কৃষক সংগঠক প্রয়াত আইয়ূব হোসেন ও তার সহযোগী বন্ধুকে (সাংবাদিক লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল) ২০১০ সালে ঢাকার ফার্মগেটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস মিলনায়তনে তখনকার কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী পুরস্কৃত করেছিলেন। কৃষক সংগঠক সেই আইয়ূব হোসেনের জীবদ্দশায় এই কেন্দ্রের উদ্যোগে তখন এ এলাকায় দেশের সকল স্বনামধন্য কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ ও অগণিত বিদেশী বিজ্ঞানীদের পদচারণা ঘটেছিল। সেই বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের মডেলকে সামনে নিয়েই এখন সারা দেশেই চলছে বিষ মুক্ত সবজি উৎপাদনের আন্দোলন।
গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রে বিগত ২০২১ সালের ১০ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন উপলক্ষে সকল কৃষিক্লাবের কৃষক প্রতিনিধিদের নিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন হয়েছিল। বৈঠকে অনেক কিছু আলোচনার মধ্যে এ দেশের কৃষকের পেনশন ভাতা চালু করা হোক দাবিটা প্রাধান্য পেয়েছিল। এ রিপোর্টটি তখন অন্তত ১০ টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হয়েছিল। গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের একটি কৃষি ক্লাব বড় খুদড়া গ্রামের স্কুল মাঠে শাইখ সিরাজের ‘কৃষকের বাজেট ভাবনা’ অনুষ্ঠান ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানেও এই দাবিটা সেই সময় জীবদ্দশায় আমাদের সেই কৃষক সংগঠক আইয়ূব হোসেন উত্থাপন করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠনে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। আওয়ামী লীগের বিগত নির্বাচনী ইস্তেহারে ষাটোর্ধŸ জনগণের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উল্লেখ ছিল বলে জানা যায়।
মোদ্দাকথা আমরা সারাদেশের জনগণ চাইবো পেনশন স্কিমটি যে প্রক্রিয়াই হোক ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্š‘ভুক্ত করে ১ বছরের মধ্যেই চালু করা হোক। নইলে যেখানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে সারা দেশের জনগণের নাভিশ্বাস চলছে, সেখানে বিষয়টির কালবিলম্ব হলেই নির্বাচনী মুলা ঝুলানোর সামিল অর্থবাচক হবে। তাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত এ খবরটির অবমূল্যায়ন করা হবে এবং জনগণও তা মেনে নেবে না। তাই শুভ কাজ শিঘ্রংগতি, অশুভ কাজ কাল বিলম্ব।
লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল (লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক)