বাগেরহাট প্রতিনিধি
উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট যুগ যুগ ধরে দেশের নারকেল উৎপাদনের সিংহভাগ জোগান দিয়ে এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলের এ জেলাকে ‘নারকেলের রাজধানী’ও বলা হয়। এ জেলার প্রধান অর্থকরী ফসলের মধ্যে নারকেল অন্যতম। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কমবেশি নারকেল পাওয়া যেত। তবে এক দশকের বেশি সময় ধরে নারকেল উৎপাদনে ভয়াবহ ধস নেমেছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় অঞ্চল খুলনা, সাতক্ষীরা ও নড়াইলসহ চার জেলায় প্রায় ২০ লাখ নারকেল গাছ রয়েছে। এর মধ্যে এককভাবে বাগেরহাটে রয়েছে ১০ লাখ ৪৫ হাজার ২৮০টি গাছ। একসময় এখানকার নারকেল শুধু স্থানীয় চাহিদাই পূরণ করত না, বিভিন্ন জেলায়ও সরবরাহ হতো। লাভজনক হওয়ায় নারকেলকে ঘিরে দুই যুগ আগে বাগেরহাটে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি অটো কোকোনাট অয়েল মিল। হাজারো মানুষের জীবিকা নির্ভর করত এ শিল্পের ওপর। কিন্তু এখন সেই ঐতিহ্য ভেঙে পড়েছে।
২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে নারকেল গাছে সাদা মাছি বা হোয়াইট ফ্লাইয়ের আক্রমণ শুরু হয়। এ পোকা সন্ধ্যার পর গাছের পাতায় আক্রমণ করে। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে যায়, ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং অনেক গাছ ধীরে ধীরে মরে যায়। ইতোমধ্যে জেলায় নারকেল উৎপাদন অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী বাগেরহাটের নারকেল গাছে সাদা মাছির আক্রমণ সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থা প্রয়োগ করে পোকা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে কৃষি বিভাগ এখনও এই পোকা দমন ব্যবস্থার চূড়ান্ত ‘গাইডলাইন’ প্রকাশ করতে পারেনি। স্থানীয় কৃষক, কৃষি বিভাগ এবং কোকোনাট অয়েল মিল মালিক সমিতির কাছে থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
জেলা সদরসহ কচুয়া, ফকিরহাট, চিতলমারী, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও রামপাল উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নারকেল গাছের পাতা ও ফলের ওপর কালো আবরণ। এটি সাদা মাছি বা হোয়াইট ফ্লাই নামক পোকার আক্রমণ। পোকাগুলো প্রথমে পাতার উপর বসে বাসা গড়ে এবং দিনের আলো থেকে লুকিয়ে থাকে, সন্ধ্যায় বের হয়। প্রতিদিন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, ফলে গাছের পাতা নষ্ট হয়, গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ফলন কমে যায়। দীর্ঘমেয়াদী এই আক্রমণে গাছ মারা যায়।
সদরের রহিমাবাদ গ্রামের ব্যবসায়ী বাদল বেগ জানান, ‘আমাদের হাজারো নারকেল গাছ থাকলেও এখন উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে গিয়ে মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগে এসেছে।’
সদরের গোটাপাড়া ইউনিয়নের আবদুল মান্নান জানান, ‘প্রতিবছর বর্ষার শেষে নারকেল পেড়ে উঠানে রেখে দিতাম। প্রয়োজনে খাওয়ার জন্য বাড়িতে নিতাম। এখন আর সেই সময় নেই।’
এ ইউনিয়নের গৃহিনী সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আমার বসত বাড়ি ও বাগানে আগের মতো নারকেল উৎপাদন হয় না। বাজারে নারকেলের দামও লাগামছাড়া-একটি নারকেল ১০০ টাকায়ও পাওয়া যায় না। ফলে পিঠা-পায়েসের মতো ঐতিহ্যবাহী খাবারও অনেক বাড়িতে দুর্লভ হয়ে পড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক লিটার নারকেল তেল উৎপাদনে ১২টি নারকেল লাগে। বর্তমান দামে এক লিটার তেল উৎপাদন খরচই দাঁড়ায় প্রায় ১৪০০ টাকার ওপরে। দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতা কমেছে, অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে।
বাগেরহাট বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক শরিফ সরদার জানিয়েছেন, ‘এ এলাকায় নারকেল উৎপাদন আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। নারকেল শিল্পের ওপর ভর করে গড়ে উঠা অনেক কোকোনাট অয়েল মিল এখন প্রায় বন্ধ। বর্তমানে ১৮টি মিল রয়েছে, তবে এগুলো শুধুমাত্র তেল উৎপাদনের অর্ডার পেলে চালু করা হয়। তবে দুই যুগ আগে কতগুলি মিল ছিল এবং কতজন মানুষের জীবন নারকেল শিল্পের ওপর নির্ভর করত, তার সঠিক হিসাব জানা নেই।’
তিনি আরও জানান, ‘নারকেল উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রধান তিনটি কারণ হলো- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সাদা মাছির আক্রমণ এবং নারকেল পরিপক্ব হওয়ার আগে ডাব বিক্রি করা। এর ফলে অনেকে নারকেল মিল বন্ধ করে অন্য ব্যবসায় ঝুঁকছেন।’
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোতাহার হোসেন জানান, ‘দেশের বেশির ভাগ নারকেল উৎপাদন হয় বাগেরহাট থেকে। তবে বিভিন্ন কারণে নারকেল উৎপাদন গত কয়েক বছরে অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। জেলায় কয়েক বছর আগে হোয়াইট ফ্লাই বা সাদা মাছির আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে উৎপাদন ক্রমশ কমতে থাকে। গত বছরে ৩ হাজার ৬৫৪ হেক্টর জমিতে মাত্র ৩৩ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন নারকেল উৎপাদন হয়েছে, যা পূর্বের তুলনায় অনেক কম।’
তিনি আরও জানান, ‘উপকূলীয় এলাকায় নারকেল উৎপাদন উন্নয়নে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া নারকেল চাষিদের গাছের পরিচর্যা, গাছে উঠা ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেয়া হবে। প্রশিক্ষণের পর চাষিদের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে।’