কল্যাণ ডেস্ক
জুলাই-আগস্টে আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাবেক ১০ মন্ত্রীসহ ২০ জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রসিকিউশন টিমের দুইটি পৃথক আবেদনের শুনানির পর রবিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল এ আদেশ দেয়।
অন্যান্য মামলায় গ্রেপ্তারের পর কারাগারে থাকা এই সাবেক মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণি, শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আরেক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী, সাবেক বিমান মন্ত্রী ফারুক খান, সাবেক কৃষি মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, জুনায়েদ আহমেদ পলক।
আরও রয়েছেন রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, কামাল আহমেদ মজুমদার, গোলাম দস্তগীর গাজী, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম।
এছাড়া আরেক আবেদনে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানসহ ৬ জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ট্র্যাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হাসান, পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল কাফি, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, পুলিশ কর্মকর্তা আরাফাতুল ইসলাম, তেজগাঁও থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলাম।
এর আগে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই ১৪ জনকে গণহত্যার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজিরের জন্য দুটি আবেদন করেন।
আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, সাবকে ১০ মন্ত্রীসহ ১৪ জন এবং সেনা-পুলিশের ৬ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার জন্য দুটি আবেদন জানিয়েছিলাম, শুনানি শেষে আদালত আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দিয়েছেন। ১০ মন্ত্রীসহ ১৪ জনকে ১৮ নভেম্বর এবং ৬ সেনা-পুলিশ কর্মকর্তাকে আগামী ২০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে কারা-কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর।
এর আগে গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়ে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “এই ২০ জন বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছি। তাদের গ্রেপ্তারের আবেদন করা হয়েছিল। তাদের আদালতে হাজির করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
আরেকটি আবেদনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ১৭ জন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ারা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “১৭ জনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলাম, আদালত পর্যালোচনা করে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরেয়ানা জারি করেছেন। আমরা নিরাপত্তাজনিত কারণে ১৭ জনের সবার নাম বলছি না। এই আদেশ পৌঁছানোর আগেই যাতে তারা পালিয়ে যেতে না পারে।
“তবে আদালতে উপস্থাপনের সময় আপনারা (সাংবাদিক) শুনেছেন যে, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান রয়েছে। বাকি সবাই পুলিশ কর্মকর্তা।” আরও অনেক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ এসেছে জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, “এই মামলার ঘটনার সঙ্গে যে সকল পুলিশ অফিসার সরাসরি জড়িত ছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে কমপ্লিট এভিডেন্স পাচ্ছি, তাদেরকেই গ্রেপ্তারের জন্য আবেদন করছি।
“সাধারণ যেসব পুলিশ সদস্য রয়েছেন, যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল না, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, তাদের কোনও ভয়ভীতির কারণ নেই। কারণ, আমরা কোনও নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাইবো না।”
ঢালাওভাবে পরোয়ানার আবেদন করা হবে না জানিয়ে তাজুল বলেন, “ক্রমান্বয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, তবে তা ঢালাওভাবে করা হবে না। প্রভাবিত হয়ে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, আবার যারা অপরাধ করেছে, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। একাত্তর সালে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের অধীনে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারককে নিয়ে। তদন্ত শেষে বিচারে আসা মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দুই বছর পর ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আগের ১৩ জন প্রসিকিউটরের সবাই একযোগে পদত্যাগ করেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম পুর্নগঠন করে।
প্রসিকিউশন টিম পুনর্গঠনের ১০ দিনের মাথায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর পুনর্গঠন করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। নতুনভাবে গঠিত তদন্ত সংস্থায় পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাজহারুল হক প্রধান সমন্বয়ক এবং সাবেক পুলিশ সুপার শহিদুল্লাহ চৌধুরী সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।