নিজস্ব প্রতিবেদক
শনিবার দুপুর দেড়টা। চারিদিকে কুয়াশাচ্ছন্ন থাকায় তখনোও বেলা উঠেনি যশোরে। উত্তরের হাওয়ার সঙ্গে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জবুথবু জটলা হয়ে আগুন পোহাচ্ছেন চাঁচড়া মৎস্য পল্লীর একদল জেলে। এভাবে আগুন পোহাতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল কেটে যায়। তবুও সূর্যের দেখা না মেলায় মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়। দিন শেষে পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকার হিসেব তাদের। আর রাতে কনকনে শীতে পাতলা কাঁথা বা কম্বল গায়ে জড়সড় হয়ে ঘুমানো। শীত মৌসুমে গেল কয়েকদিন চাঁচড়া মৎস্য পল্লীর জেলে শ্রমিকদের জীবনযাপন ঠিক এরকমই। মৃদ শৈত্যপ্রবাহে একদিকে এই মানুষগুলোর জীবন বিপর্যস্ত; তেমনি কর্মহীন হয়ে প্রায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
কাজ বন্ধ থাকায় আগুন পোহাতে দেখা যায় চাঁচড়ার ভাতুড়িয়ায় সিরাজ শেখের। তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে যশোরে খুব ঠাণ্ডা পড়ছে। ডাঙ্গায় মানুষ টিকতে পারছে না; পানিতে তা হলে কি অবস্থা বুঝেন! প্রচণ্ড শীতে মধ্যে জবুথবু হয়ে রোদের অপেক্ষায় সকাল থেকে বসে ছিলাম। রোদ না উঠায় আজ আর কাজ হয়নি। তাই কাজ না করেই বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে। গেল সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন এভাবেই কাজ না করেই চলে যেতে হয়েছে তাদের।
গেল কয়েক দিন ধরে যশোরে শীতের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। শীতের কারণে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে কর্মজীবী সাধারণ মানুষ। ভোরের দিকে শীতের সঙ্গে ঘন কুয়াশার কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে কম। শীতের তীব্রতায় কর্মহীন হয়ে পড়ছে শ্রমজীবী মানুষরা।
যশোর মতিউর রহমান বিমান ঘাঁটি আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, শনিবার যশোরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরআগে বৃহস্পতিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন পর্যন্ত গতকালের তাপমাত্রা এই জেলায় সর্বনিম্ন। গত এক সপ্তাহে জেলাতে সর্বনিম্ন ৯ থেকে ১৪ ডিগ্রির মধ্যে সেলসিয়াস তাপমাত্রাতে প্রচণ্ড শীতে জনজীবনে জবুথবু অবস্থা। শীত নিবারণের জন্য মানুষ গরম কাপড়ের সন্ধানে ছুটছেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল মানুষেরা নতুন কাপড় ক্রয় করছেন। কিন্তু বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। শহরের পুরাতন কাপড়ের দোকানে ভিড় বাড়ছে। শীতে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আয়ে ছিন্নমূল মানুষ। তারা শীতবস্ত্রের জন্য মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে। তবে সেটি পর্যাপ্ত নয়। জনপ্রতিনিধিরা পাশে নেই বলে অভিযোগ। সরকারি বরাদ্দের কম্বল বিতরণ করেই দায় সারছেন অনেকে। জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই শীতে মানুষের পাশে নেই। নুরনবী নামে এক জেলে বলেন, সরকার কম্বল দেয় শুনেছি। সেসব আমরা পায় না। যা দেয় সবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা লোকেরা পায়। কম্বল পাওয়া কয়েকজন জানিয়েছেন, সরকারি কম্বল পেয়েছি। তবে সেটির মান অনেক কম। কম্বল দিয়ে শীত যায় না বলে অভিযোগ।

প্রশাসন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে কম্বল বিতরণ করা হলেও বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি প্রচণ্ড শীতের মধ্যে জনগণের পাশে নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। শীতে নিম্ন আয়ের ছিন্নমূল মানুষের কষ্ট বেড়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সরকারি কর্মকর্তা জানান, সরকারিভাবে প্রত্যেক উপজেলায় কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। সেই কম্বল জনপ্রতিনিধিদের দেয়া হয়েছে। বরাদ্দের কম্বল ছাড়া অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিরা নিজ উদ্যোগে এখনো শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু করেনি। তবে বেসরকারি বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু করেছে।
ঝিকরগাছা পৌরসভার মেয়র মোস্তফা আনোয়ার পাশা জামাল বলেন, সরকারিভাবে এখনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। পৌরসভার নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার পিস কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। যশোর পৌরসভার মেয়র হায়দার গণি খান পলাশ বলেন, কাল অথবা পরশু শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু করবো। মানুষের চাহিদা অনেক, সাধ্যমত বিতরণ করা হবে। জেলে পল্লীতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কম্বল বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়া ৪৯ হাজার ৫শ’ পিস কম্বল ইতোমধ্যে জেলার ৮ উপজেলায় বিতরণ করা হয়েছে। আরও কম্বলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে।
শার্শা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু বলেন, ‘সরকারি কম্বল যা পেয়েছি সব বিতরণ শেষ। উপজেলা বা ব্যক্তি উদ্যোগে কম্বল বিতরণ করছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখনো করেনি। তবে প্রতিবারই দিয়ে থাকি। সরকারি কম্বলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। এই সব বিষয়ে বাঘারপাড়া, মণিরামপুরসহ কয়েকটি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও মেয়রের নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে কেউ রিসিভ করেননি। তবে খোঁজ খবর নিয়ে জানাগেছে এখনো সরকারি কম্বল ছাড়া জেলার কোন উপজেলাতেই জনপ্রতিনিধিরা ব্যক্তি উদ্যোগে কম্বল বিতরণ শুরু করেনি। সরকারি বরাদ্দের কম্বল বিতরণ করেই দায় সারছেন তারা।
এদিকে, শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাঁচি-কাশিসহ কোল্ড ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অপরদিকে শীতের কারণে সারাদিনই গরম পোশাক পরে মানুষজনকে চলাচল করতে দেখা যায়। হাসপাতালেও বাড়ছে রোগীর চাপ। চিকিৎসকরা শীতকালীন রোগবালাই থেকে রক্ষা পেতে গরম পানি পান করাসহ গরম কাপড় ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আবদুস সামাদ বলেন, শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। রোগীর চাপ থাকলেও হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে কোন সমস্যা হচ্ছে না।
১ Comment
Good New