নিজস্ব প্রতিবেদক
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোর জেলার সভাপতি প্রয়াত অধ্যাপক সুকুমার দাসের মুত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সবার মাথার ওপর ছায়ার মতো ছিলেন। তিনি ছিলেন বটবৃক্ষ। তার ছায়াতলে অনেক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি আশ্রয় নিয়েছিলেন। একইসঙ্গে সত্য ও সুন্দরের প্রতীক ছিলেন তিনি। সাহসী এই মানুষ সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে লড়াই করেছেন অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার। সাংস্কৃতিক চর্চায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন যশোরসহ বিভিন্ন জেলায়। শুক্রবার সন্ধ্যায় যশোর টাউন হল ময়দানের রওশন আলী মঞ্চে সুকুমার দাসের স্মরণে নাগরিক শোকসভায় বক্তারা এ কথা বলেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোর জেলা শাখা এই নাগরিক শোকসভার আয়োজন করে।
শোকসভায় যশোরে সাংস্কৃতিক চর্চায় বটবৃক্ষের মতো ভূমিকা রাখায় সুকুমার দাসকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করার দাবি তোলেন বক্তারা।
শোক সভায় যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক অঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন সুকুমার দাস। তিনি সব সময় যশোরের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি তার সকল দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। তিনি শুধু যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অরিহার্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন তার কাজ কর্মের মাধ্যমে। যশোরের জেলা প্রশাসন এই সাংস্কৃতিক যোদ্ধাকে আজীবন মনে রাখবে। পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার বলেন, ‘শুদ্ধ সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে সুকুমার দাস অবদান রেখে গেছেন যশোরে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক নিবেদিত প্রাণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তি ছিলেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব সুকুমার দাস অকাল প্রয়াণে শুধু যশোরে নয়; গোটা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একঅপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তার জীবনবোধ উপলদ্ধি এবং ধারণ করলেই তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন নিশ্চিত হবে।
শোকসভায় বক্তারা আরো বলেন, ‘দক্ষিণবঙ্গের বাংলাদেশের গণসংগীতের প্রাণপুরুষ সুকুমার দাস, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত এক তারকা সংগঠক ছিলেন। বিস্ময়কর প্রাণশক্তিতে বলিয়ান এই মানুষটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সন্ত্রাস ও মানবতার বিপক্ষে কোন ঘটনা ঘটলেই প্রতিবাদ ও আন্দোলন করে গেছেন। সমাজের কিছু মানুষ থাকে যাদের কোন বিকল্প হয় না। সুকুমার দাস তেমনি একজন মানুষ। নিরাহংকার নিরুলোভী মানুষটা সৎ সাহস নিয়ে মরার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি কখনো। তাই সাংস্কৃতিক এই যোদ্ধাকে সম্মানিত করতে রাষ্ট্রীয় কোন সম্মাননা বা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করার দাবি তোলেন বক্তারা।
নাগরিক শোকসভা কমিটির আহ্বায়ক হাবিবা শেফার সভাপতিত্বে আরোও বক্তব্য রাখেন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রফেসর মর্জিনা আক্তার, মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর যশোরের মুজিববাহিনীর উপ-প্রধান রবিউল আলম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন, যশোর পৌরসভার মেয়র বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার গণি খান পলাশ, কমরেড ইকবাল কবির জাহিদ, বাংলাদেশ সম্মিলিত সাংস্কতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, যশোর সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি দৈনিক কল্যাণ সম্পাদক বীরমুক্তিযোদ্ধা একরাম-উদ-দ্দৌলা, প্রেসক্লাব যশোরের সম্পাদক তৌহিদুর রহমান, যশোর ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ডা. আবুল কালাম আজাদ, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন সাবেক সভাপতি ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল, বীরমুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন দুদুল, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বুলু, সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) যশোরের অধ্যক্ষ শাহীন ইকবাল, উদীচী যশোরের সভাপতি তন্দ্রা ভট্টচার্য্য, তির্যক যশোরের সভাপতি দীপংকার দাস রতন, অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন, ডা. ইয়াকুব আলী, ডা. নাছিম রেজা, পথনাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ গিয়াজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্রাবণী সুর, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাসুদেব বিশ্বাস, সুকুমার দাসের স্ত্রী শুক্লা দাস প্রমুখ। এর আগে সুকুমার দাসের স্মরণে তার স্বরচিত গান এবং শোকগান পরিবেশন করেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।
প্রসঙ্গত, গত ১২ এপ্রিল রাতে হৃদরোগ আক্রান্ত হলে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে সুকুমার দাসের বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। তিনি ছিলেন যশোর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য, পুনশ্চ যশোরের প্রতিষ্ঠাতা এবং যশোর শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সহসভাপতি। এর আগে তিনি দেশের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী যশোরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে উদীচী থেকে বের হয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পুনশ্চ যশোর। সুকুমার দাসকে যশোরের সাংস্কৃতিক কর্মীরা বিশেষ করে গানের শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ হিসেবে সম্মান জানাতেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গণে ছিলেন গানের শিক্ষক। বিশেষ করে গণসংগীতে তিনি ছিলেন এক ও অনন্য। তার কণ্ঠে ভূপেন হাজারিকার গানও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন শ্রোতা। একাধারে তিনি ছিলেন তুখোড় সংগঠকও।