জাহিদ হাসান
১৯ মে শুক্রবার বিকাল সাড়ে চারটা। যশোর শহরের পূর্ব বারান্দিপাড়া কাঠালতলা এলাকায় শতদল পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ধ্বংসাত্মক ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য জড়ো হয়েছেন বিএনপির কিছু নেতাকর্মী। এমন খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যেয়ে ৬ জনকে আটক করে। বাকিরা পালিয়ে গেলেও চার জন্য সাক্ষীর সামনে ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি ককটেল, বোমা, ইটের টুকরো ও লাঠিসোটা উদ্ধার করা হয়। যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় উপ পরিদর্শক জয় বালা বাদী হয়ে একটি মামলার এজাহারে দেওয়া হয়েছে এমন বর্ণনা।
এজাহারে তথ্য অনুযায়ী শুক্রবার সন্ধ্যায় শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের শতদল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কর্মী সভা করার প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশ সেখানে কোনো কর্মী সমাবেশ করা যাবে না বলে স্থানীয় ছয়জন নেতাকর্মীকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি ককটেল, বোমা, ইটের টুকরো ও লাঠসোটা উদ্ধারের দাবি করে পরের দিন শনিবার পুলিশ নাশকতার অভিযোগ এনে ৪৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। এতে জেলা বিএনপির ১১ জন শীর্ষ নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ শীর্ষ এই ১১ নেতা উপস্থিত তো ছিলেন না বরং তাদের মধ্যে একজন ঘটনার আগে থেকে রয়েছেন ভারতে। এই মামলাকে ‘গায়েবি’ হিসেবে উল্লেখ করে বিএনপি বলছে, আসামিদের অনেকেই ঘটনাস্থলেই ছিলেন না।
এই মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও পৌরসভার সাবেক মেয়র মারুফুল ইসলাম রয়েছেন। অথচ মামলায় ঘটনার যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, তখন তিনি ভারতের মুম্বাইয়ে ছিলেন। সোমবার দুপুরে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে মারুফুল ইসলাম দৈনিক কল্যাণকে বলেন, ‘১৬ মে থেকে আমি যশোরে নেই; ঢাকায় ছিলাম। এরপর ১৯ মে সন্ধ্যার ফ্লাইটে ভারতে আসি। এখনো মুম্বাই শহরে আছি। পুলিশ নাশকতার মামলা সাজিয়েছে। এ সরকারের আমলে আমার বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে; সবকয়েকটি ঘটনায় আমি ছিলাম না। তার পরেও হামলা মামলায় আমাকে নাজেহাল করেছে পুলিশ। যশোর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কর্মীদের মতবিনিময় সভার দায়িত্বপ্রাপ্ত নগর (শহর) বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক হোসেন বলেন, ওই বিদ্যালয়ের মাঠে অনুষ্ঠিত কর্মীদের মতবিনিময় সভায় জেলা বিএনপির, যুবদল ও ছাত্রদলের কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না। মূলত ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে ওই সভা করা হয়। আমাদের কাছে কোন নাশকতামূলক কোন কিছু ছিলো না।
মামলার আসামি জেলা বিএনপির সদস্য মিজানুর রহমান খান বলেন, জেলা বিএনপির কোনো নেতা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। এমনকি জেলা ছাত্রদল ও যুবদলেরও কেউ ছিলেন না। অথচ সবার নামে ‘গায়েবি মামলা’ দিয়েছে পুলিশ। শুক্রবারের ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে চারজনের সাক্ষী হিসেবে দেখানো হয়েছে। চার জনের একজন শহরের পূর্ব বারান্দিপাড়া বউ বাজার এলাকার মুদি দোকানদার ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, ‘স্কুলের মাঠে প্রোগ্রাম করার জন্য বিএনপির নেতাকর্মীরা আসেন। পুলিশ গিয়ে রেড (তল্লাশি) দেয়। অনেক ভিড়ভাট্টা দেখলাম। পুলিশ একটা কাগজে সই করে দিতে বললো, দিলাম।’ বাকীদের সঙ্গে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোন কথা বলবেন না বলে জানান।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জনগণের দাবি আদায়ের লক্ষে বিএনপির নেতাকর্মীরা রাজপথে সরব হয়েছে। তাছাড়া আগামি ২৭ মে বিএনপির সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থাকার কথা রয়েছে। জেলার শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলছেন, সমাবেশ বানচাল করতে ও নেতাকর্মীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে এসব মামলা ও ধরপাকড় চলছে। এমনকি দেশে নেই এমন এক নেতাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। জেলার শীর্ষ পর্যায়ের ১১ নেতাসহ ৪৭ জনকে এমন মামলায় জড়ানো হয়েছে যেখানে তারা উপস্থিত ছিলেন না। আসামিদের তালিকায় যে ১১ নেতার নাম আছে তারা হলেন যশোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন, সদস্য সচিব সৈয়দ সাবেরুল হক, কমিটির সদস্য ও যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান, মারুফুল ইসলাম, কাজী আজম, মুনীর আহমেদ সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম, জাতীয়তাবাদী যুবদলের জেলা কমিটির সহসভাপতি আমিনুর রহমান ও যুগ্ম সম্পাদক নাজমুল হোসেন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জেলা কমিটির সভাপতি রাজিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান। এছাড়া যশোরে বিএনপির সমাবেশের প্রাক্কালে দলটির নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করা হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে দলটির ১৪৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলাও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন নেতারা। আটককৃত নেতাকর্মীরা আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।
যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু দৈনিক কল্যাণ বলেন, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যশোরের সমাবেশে বক্তৃতা করতে আসবেন। সেই কর্মসূচি সফল করার জন্য প্রত্যেক ওয়ার্ডে কর্মীসভা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বিদ্যালয়ের মাঠে শান্তিপূর্ণ সেই কর্মীসভা চলাকালে পুলিশ গিয়ে কর্মী সভা করা যাবে না বলে কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আটক করে। সেখানে বোমা-ককটেল বা লাঠসোটা নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ পুলিশ বোমা ককটেল উদ্ধার দেখিয়ে নাশকতার মামলা দিয়ে জেলা ও স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। ঘটনাস্থলে অনেকেই ছিলো না, এমনকি ভারত বা ঢাকাতে অবস্থান করা নেতাদের নামেও এসব গায়েবি প্রহসনের মামলা দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সরকার দীর্ঘদিন ধরে এসব গায়েবি মামলা দিয়ে আসছে; তারই অংশ হিসাবে এসব মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মামলায় সোমবার আমরা ২৪ জন হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছি।
মামলাটির বাদী যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় উপ পরিদর্শক জয় বালার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এজাহারের বর্ণনায় আমার বক্তব্য। তবে তিনি এই বিষয়ে ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আর যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, গায়েবি মামলা বলে কিছু জানা নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক উপদানাবলী আইনে একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ৪৭ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকেই কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে ছিলো না এমনকি ভারতে অবস্থান করছে তাদের নামেও মামলা হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিএনপি তো কত কথায় বলে। তাদের কথা শুনতে গেলেতো হবে না। আমরা যা তদন্ত করে পেয়েছি সেটাই এজাহারে বর্ণনা করা হয়েছে। আর আপনারা (সাংবাদিকরা) যা তদন্ত করে পাবেন সেটা লেখেন।
এই বিষয়ে যশোর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন ও পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়াদারের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কেউ ফোন রিসিভ করেনি।