এহসান-উদ-দৌলা মিথুন
তরিকুল ইসলাম। রাজনীতির এক প্রবাদ পুরুষ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বীয় মহিমায় উজ্জ্বল একটি নাম। ছাত্র রাজনীতিতে হাতেঘড়ি পরবর্তীতে। তুখোড় রাজনীতিবিদ। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতিতে এক মহিরুহে পরিণত হন তিনি। নিজের কর্মগুণে নেতা থেকে জননেতায় পরিণত হন। আজ ৪ নভেম্বর এই কীর্তিমান রাজনীতিকের মৃত্যুবার্ষিকী।
নেতৃত্বের গুণাবলী সবার মধ্যে থাকে না। একজন প্রকৃত নেতা তিনিই যিনি কর্মীর মনের ভাষা পড়তে পারেন, চোখের দিকে তাকালেই কর্মীকে বুঝতে পারেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন কর্মীর নামও স্মরণ রাখতে পারেন-আমাদের তরিকুল ইসলাম ছিলেন এমনি একজন ক্যারিশমাটিক নেতা, তাঁর সুযোগ্য পুত্র বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত একই গুণের অধিকারী হয়ে উঠেছেন। নেতা যদি প্রকৃত কর্মীকে চিনতে না পারেন, কর্মীর মনের ভাষা পড়তে না পারেন, কর্মীর বিপদে-সংকটে সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াতে না পারেন-তিনি নেতা নন, তিনি অভিনেতা। যশোরবাসীর সৌভাগ্য তারা এমনি একজন নেতাকে পেয়েছিলেন যিনি ক্ষমতায় থাকার সময়ও যেমন দলীয় সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ সর্বসাধারণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ক্ষমতার বাহিরে থেকেও সমভাবে ছিলেন নেতাকর্মীদের পাশে, সাধারণ মানুষের পাশে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা তরিকুল ইসলাম চাচা। তিনি যশোরবাসীর গর্ব, যশোরবাসীর অহংকার, যশোরের সত্যিকারের উন্নয়নের রূপকার ও সফল বাস্তবায়নকারী।
তরিকুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মরহুম তরিকুল ইসলাম ১৯৬১ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬৩ সালে মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৮ সালে একই কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাস করেন। বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন তরিকুল ইসলাম।
তরিকুল ইসলামের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে। একজন কর্মী হিসেবে যাত্রা শুরু করে তিনি যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে যশোর এম এম কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে একজন ছাত্রনেতা হিসেবে বৃহত্তর যশোর জেলায় প্রচারকার্যে বিরাট ভূমিকা রাখেন। এতে আইয়ুব সরকার তার প্রতি ক্ষুব্ধ এবং তিনি গ্রেফতারসহ নানা নির্যাতনের শিকার হন। এম এম কলেজে শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নেয়ায় তাকে প্রথম কারা ভোগ করতে হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে যশোরের এম এন এ-এর মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে তরিকুল ইসলাম ৯ মাস কারাবরণ করেন। ১৯৬৯ সালে গণতান্ত্রিক ছাত্র গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়েও কয়েক দিনের জন্য তাকে হাজতবাস করতে হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র গণ-আন্দোলনে তার পুরো ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছিল।
মরহুম তরিকুল ইসলাম ১৯৭০ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগদান করেন। ১৯৭১-এ ভারতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখেন। স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭৩ সালে যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১৯৭৮ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, একনায়কসুলভ আচরণ ও রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় তিনি ১৯৭৫ সালে তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৭৯ সালে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ন্যাপ বিলুপ্ত করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালে শাসকদল আওয়ামী লীগ এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল সৃষ্টির ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণের লক্ষ্যে শহীদ জিয়া বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। বিএনপির আদর্শ এবং শহীদ জিয়ার উৎপাদনের রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে তরিকুল ইসলাম বিএনপিতে যোগদান করেন। এর পরপরই তাকে দলের যশোর জেলা কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে যশোর-৩ আসন থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এর মাধ্যমে সংসদীয় রাজনীতিতে তার অভিষেক ঘটে।
১৯৮০ সালে জেলা বিএনপির প্রথম সম্মেলনে তিনি সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের মন্ত্রিসভায় তরিকুল ইসলাম সড়ক, যোগাযোগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অস্ত্রের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক আইন জারি করেন সেনাপতি এরশাদ। তার ক্ষমতা দখলের পর বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার ও নির্যাতন এবং অন্য দিকে বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। শহীদ জিয়ার আদর্শের সৈনিক ও সাচ্চা জাতীয়তাবাদী নেতা তরিকুল ইসলাম দল ভাঙার খেলায় যোগ দেননি। তিনি সাহসের সাথে বিএনপির মূল ধারায় শক্তভাবে অবস্থান গ্রহণ করেন। ফলে মরহুম তরিকুল ইসলামের ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। ১৯৮২ সালেই তাকে গ্রেফতার এবং এরশাদ হত্যার চেষ্টার কথিত মামলায় আসামি করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে অনেক দিন অজ্ঞাত স্থানে রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন করা ছাড়াও দীর্ঘ ৯ মাস কারাবন্দী রাখা হয়।
মুক্তিলাভের পর তিনি বিএনপির নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনে বৃহত্তর যশোর জেলা এবং কেন্দ্রে সাহসী ভূমিকা রাখেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৬ সালে বিএনপির পুনর্গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে বেগম জিয়া তাকে দলের যুগ্ম মহাসচিবের পদে অধিষ্ঠিত করেন। দায়িত্বশীল একজন নেতা হিসেবে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার একজন বিশ্বস্ত ও নিবেদিত প্রাণকর্মী রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আন্তর্র্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ’৯১-এর নির্বাচনে জনগণ বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন করে। তিনি তরিকুল ইসলামকে ১৯৯১ সালে সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৯৯২ সালে তাকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়। খালেদা জিয়া সরকারের মেয়াদকালের পূর্ণ সময় তিনি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়কালে তিনি বিরোধী দলের একজন নেতা হিসেবে সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদ করেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাহসী ভূমিকা রাখেন। জাতীয় স্বার্থবিরোধী গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করে যশোর এবং কেন্দ্রে আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার পার্বত্য চুক্তিবিরোধী ঐতিহাসিক লংমার্চে তিনি বীরোচিত ভূমিকা পালন করে ছিলেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে তরিকুল ইসলাম যশোর-৩ আসন থেকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বেগম জিয়া দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সরকারে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়কালে তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এ সময়কালে মরহুম তরিকুল ইসলাম বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদে উন্নীত হন। ২০০১-২০০৬ সময়কালে সরকারে এবং দলে দায়িত্বে থাকাকালে নিষ্ঠা ও দক্ষতার পরিচয় দেন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জাতীয় জীবনে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা হলো। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল এবং দেশে জরুরি আইন জারি করে ‘১/১১’ নামের অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সরকার ‘মাইনাস টু’ এবং বিরাজনীতিকীকরণের অ্যাজেন্ডা নিয়ে দেশের দুই বৃহৎ দলের দুই প্রধানসহ প্রায় সব নেতাকে ঢালাওভাবে অপবাদ দিয়ে গ্রেফতার করেছিল। মরহুম তরিকুল ইসলামও গণগ্রেফতার থেকে রেহাই পাননি। অন্য দিকে তার স্ত্রী ও সন্তানরা বিভিন্ন মিথ্যা মামলার আসামি হয়ে পলাতক ছিলেন। মরহুম তরিকুল ইসলাম ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে ১/১১-এর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও সাহসী, দৃঢ়চিত্ত, নীতির প্রতি আপসহীন রাজনৈতিক যোদ্ধা ছিলেন। তিনি একজন নির্যাতিত ও সংগ্রামী নেতার রোল মডেল। ২০০৯ সালের দলের জাতীয় কাউন্সিলে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নীতিনির্ধারণী ‘জাতীয় স্থায়ী কমিটির’ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তরিকুল ইসলাম চাচাকে ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি। তাঁর সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো। যশোর শহরের ঘোপ এলাকায় আমার জন্ম। সেটা ৮০ দশক। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সময় প্রায়ই তরিকুল ইসলাম চাচা আমাদের বাসায় আত্মগোপনে থাকতেন। আমার বাবা একরাম-উদ-দ্দৌলার সাথে তার ভীষণ ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি আব্বাকে ভীষণ ভালোবাসতেন ও বিশ^াস করতেন। আমার বাবা সাংবাদিকতা পেশায় থাকায় তিনি আমাদের বাসা নিরাপদও মনে করতেন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তরিকুল চাচাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে পা ভেঙে দেয়। তিনি ক্রাসভর করে গভীর রাতে আমাদের বাসায় আসতেন। আব্বা আর তরিকুল চাচা এক ঘরে এক খাটে ঘুমাতেন। আমাদের নানা দুর্যোগ, দুঃসময়ে তরিকুল চাচা আমাদের পরিবারের পাশে থেকেছেন। নানা রকম সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। তরিকুল ইসলামের প্রকাশনায় নিজস্ব পত্রিকা দৈনিক লোকসমাজ থাকলেও দলীয় কোন খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে আব্বার সম্পাদিত ও প্রকাশিত দৈনিক কল্যাণকে গুরুত্ব দিতেন সব সময়। খবরটি প্রকাশের জন্য পাঠাতে বলতেন দলীয় কর্মীদের। বলতেন কল্যাণ-এ খবরটি প্রকাশিত হলে পাঠকের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের কিছু সময় আমি তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলাম। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে খুব কাছে থেকে দেখেছি তাঁকে। যতই দেথেছি মুগ্ধ হয়েছি, সমৃদ্ধ হয়েছি। তাঁর মত বিচক্ষণ, দূরদর্শী নেতা আমি খুবই কম দেখেছি। দলমত নির্বিশেষে সব সাংবাদিকের সঙ্গেই ছিল তাঁর সখ্যতা। একইভাবে সাংবাদিকরাও তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে কী-আমার পেশাগত জীবনে তাঁর মতো সাংবাদিকবান্ধব নেতা খুবই কমই দেখেছি।
তাঁর সাথে একটা স্মৃতি আমাকে ভীষণ নাড়া দেয়। আমি প্রথম আলোয় ফটোসাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘ ১৫ বছর কাজ করেছি। প্রথম আলোয় কাজ করার সুবাদে নানা সময় প্রথম আলো ঢাকা অফিস থেকে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট কভার করার জন্য প্রথম আলোর বাঘা বাঘা সাংবাদিকরা আসতেন যশোরে। এদের মধ্যে অন্যতম আরিফুর রহমান দোলন, রাজীব নূর, শিশির মোড়ল, আহমেদ জায়িফরা যশোরের রাজনৈতিক গডফাদারদের নিয়ে নিউজ করতেন তাঁরা। এসব নিউজ করার জন্য আমাকেই তাঁরা সাথে নিয়ে ঘুরতেন। নানা রকম সোর্সদের কাছে আমিই নিয়ে যেতাম। সংবাদের গভীরের বিশ^াসযোগ্য তথ্য বের করতে দিন-রাত ঘুরতাম তাঁদের সাথে নিয়ে। এরপর প্রথম আলোয় ফলাও করে ছাপা হোত নিউজ। সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হত সেই সব নিউজ। যাদের বিরুদ্ধে নিউজ হত তাঁরা কিভাবে কিভাবে খোঁজ পেয়ে যেতো এই সব খবরের সূত্র আমিই ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিকদের যোগাড় করে দিতাম। তাই অনেক নেতাই আমার উপর রুষ্ট ছিলেন। অনেকে জীবননাশের হুমকিও দিত। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে একদিন তরিকুল ইসলাম চাচার বাসায় গেলাম অন্যকোন এক কাজে। কথা প্রসঙ্গে আমার ভয়ের কথাটা তাঁকে বলায় আমাকে অভয় দিয়েছিলেন। আমাকে সাহস যুগিয়েছিলেন। আমাকে পিঠচাপড়িয়ে বলেছিলেন ভয় করিস না বাবু… আমি সেদিন ওনার কথায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সফল জীবনে পদচিত্র রেখে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর তারিখে তিনি পরলোক গমন করেন। দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ সেই দিন হারিয়েছিল এক শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে লাখ লাখ নেতাকর্মী অশ্রুসিক্ত হয়েছিল। আমাবশ্যার কালো অন্ধকারের মত শোকের ছায়ায় গ্রাস করে সমগ্র যশোরকে। এই অঞ্চলের মাটি মানুষের সুখ দুঃখের মাঝে বেড়ে ওঠা তাদের প্রিয় নেতা, প্রিয় সন্তান, বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদ এই অঞ্চলের মানুষের দাবি আদায়ের সংগ্রামের অগ্রনায়ক, ক্রীড়াঙ্গন, সংবাদপত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রবাদ পুরুষ, রাজপথের সাহসী নেতা তরিকুল ইসলামের মৃত্যু কাঁদিয়ে ছিল যশোর তথা খুলনা বিভাগকে।
পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী বিকেল চারটার দিকে তরিকুল ইসলামের মরদেহ যশোর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে আনা হয়। শহরের সবচে’ বড় খোলা জায়গাটি অল্প সময়ের মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ঈদগাহ ছাড়িয়ে মানুষজন পুবে মুজিব সড়ক, দক্ষিণে জেলা জজ আদালত চত্বর, উত্তরে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চত্বরে কাতারবন্দি হন। এমনকি জায়গা না পেয়ে কিছু লোককে মরদেহের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখা যায়। ফলে বার বার ঘোষণা দিয়েও জানাজার নামাজ শুরু করা যাচ্ছিল না। উপস্থিত লোকজনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বিএনপি নেতারা।
লাখো মানুষ উপস্থিত হন প্রিয় নেতা তরিকুল ইসলামের নামাজে জানাজায়। যশোরের ইতিহাসে এতো বেশি মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা এর আগে কখনো হয়নি।
মানুষের স্রোত বাড়তে থাকায় এক পর্যায়ে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘একই স্থানে দ্বিতীয় জানাজা হবে। কিছু সময়ের মধ্যেই অবশ্য ধর্মীয় কারণে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। জানানো হয়, একই স্থানে দ্বিতীয় দফা জানাজা হওয়ার সুযোগ নেই। কাতারগুলোকে আরো সংকুচিত করে সামান্য ফাঁকা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এই ঘোষণার ফলে যে যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েন জানাজার নামাজ পড়তে। এমনকি কিছু লোককে মরদেহের পশ্চিম পাশে বাদশাহ ফয়সাল স্কুল, সরকারি বালিকা বিদ্যালয় স্কুলের পাশের দুই রাস্তায়ও দাঁড়িয়ে যেতে দেখা যায়।
আমি বিশ^াস করি-তাঁর জন্মই হয়েছিল রাজনীতির জন্য। আর তিনি শুধু রাজনীতিক ছিলেন না-তিনি ছিলেন এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তাই আজকে যারা রাজনীতি করছেন কিংবা আগামী দিনে রাজনীতি করবেন তাদের জন্য তরিকুল ইসলাম অবশ্যই পাঠ্য বলে মনে করি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ঐকতান’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘কৃষাণের জীবনের শরীফ যে জন,/কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,/যে আছে মাটির কাছাকাছি,/সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।’ তরিকুল ইসলামের মত আরেকজন নেতা পাওয়ার জন্য যশোরবাসী কিংবা দেশের মানুষকে কতকাল কান পেতে থাকতে হবে কে জানে!
তিনি মৃত্যুকে জয় করতে পারেনি, তিনি জয় করেছেন আমার মত বাংলাদেশের হাজার, লক্ষ নেতা-কর্মীর হৃদয়। অনন্তকাল প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আপনার রেখে যাওয়া কৃর্তি দ্বারা আপনাকে স্মরণ করবে। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করছি। মহান আল্লাহতায়ালা আপনাকে বেহেশত নসিব করুন। আমিন।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক কল্যাণ।