১৩ মাসে মুক্তি পেয়েছে ১২২ জন
সবাই ভাল আছে-প্রবেশন কর্মকর্তা
সংশোধনের সুযোগ পাচ্ছে : এপিপি
তবিবর রহমান: যশোরের চৌগাছার জগন্নাথপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে ফিরোজ হুসাইন। ২০১২ সালের ৮ আগস্ট চৌগাছা ডিগ্রি কলেজের সামনে থেকে দুই বোতল বিদেশি মদসহ পুলিশের হাতে আটক হয়েছিল। প্রমাণিত হওয়ায় চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি যশোরের যুগ্ম দায়রা জজ (২য় আদালত) তাকে দুই বছরের কারাদ- দেন। কিন্তু ১১ শর্তে তাকে বাড়িতে বসে ওই সাজা ভোগের নির্দেশ দেন বিচারক। এরমধ্যে মাদক গ্রহণ না করা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র দেখা, প্রতিমাসে দু’জন হতদরিদ্রকে দুপুরের আহার করানো, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক পাঁচটি বই পড়া ছিল অন্যতম। আদালতের এই যুগান্তকারী রায়ে বদলে গেছে তার জীবন। বিচারকের দেয়া শর্ত অনুযায়ী জীবনযাপন করাসহ আগামীর পথচলা সুন্দর করতে তিনি কাজ করে চলেছেন। এমন তথ্য দিয়েছেন তার গ্রামের অধিবাসীই কবি ও সাংবাদিক শাহানুর আলম উজ্জ্বল। এই সাংবাদিকের ভাষ্য, ফিরোজ এখন পাল্টে গেছে। একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সহযোগী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
ফিরোজের মতো মুক্তি পেয়েছেন শার্শা উপজেলার রাড়িপুকুর গ্রামের আলমগীর হোসেন। ২০০৮ সালে ১৯ জুন রাত সাড়ে সাতটায় যশোর শহরের রেলগেট পশ্চিমপাড়া থেকে নয় বোতল ফেনসিডিলসহ আটক হয়েছিলেন। গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর যশোরের যুগ্ম দায়রা জজ (২য় আদালত) শিমুল কুমার বিশ^াস তাকে এক বছরের কারাদ- দিয়ে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেন। তার বিরুদ্ধে আর কোন মামলা না থাকায় আদালত এই যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেন।
শর্ত ছিল কোনো প্রকার মাদক সেবন, বহন, সংরক্ষণ এবং সেবনকারী, বহনকারী ও হেফাজতকারীর সাথে মেলামেশা করতে পারবেন না। একইসাথে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে থেকে সার্বিক অবস্থা অবহিত করতে হবে। প্রবেশনকালীন সময়ে তাকে একাত্তরের যীশু, নদীর নাম মধুমতি, হুলিয়া, প্রত্যাবর্তন, পতাকা, আগামী, একজন মুক্তিযোদ্ধা, ধুসর, আমরা তোমাদের ভুলবোনা, শরৎ একাত্তর চলচ্চিত্র দেখতে হবে। একই সাথে তাকে ১০টি বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। ইতোমধ্যে তিনি ছয় মাস সফলতার মধ্যে পার করেছেন। তিনি সঠিকভাবে শর্ত পালন করেছেন বলে প্রবেশন অফিসার আদালতকে অবহিত করেছেন।
শার্শার কামারবাড়িস্থ ঘাটকান্দির বাবুকে একই আদালত মাদক মামলায় চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি এক বছরের সাজা দিয়ে প্রবেশনে মুক্তি দিয়ে শর্ত সাপেক্ষে বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেন। তিনি বর্তমানে সুস্থ জীবন যাপন করছেন দাবি করেছেন তার বড় ভাই মশিউর রহমান। তিনি বলেন, তার ছোট ভাই বাবু খারাপ পথে চলে গিয়েছিল। আমার মা, তার স্ত্রী, সন্তানরা সব সময় দুশ্চিন্তায় ছিলাম। বাবু এখন ভালো হয়ে গেছে। সে মাদক সেবন, সেবনকারীদের সাথে উঠাবসা করে না। এজন্য আমরা যে কতটা খুশি সেটা বলে বোঝানো যাবে না।
২০১৪ সালের ১০ আগস্ট ঝিকরগাছা বাসস্ট্যান্ড থেকে একই উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের সিরাজুল ইসলামকে তিন গ্রাম হেরোইন আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বেনাপোল সার্কেলের সদস্যরা। এ মামলায় আদালত ১১ শর্তে আসামিকে দুই বছরের প্রবেশনে মুক্তি দেন। তার শর্তের মধ্যে মাদকের সাথে জড়িত না থাকা, পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখা, করোনাকালীন জনসচেতনতা সৃষ্টি ও মানুষকে মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ, বাড়ির আঙিনায় তিনটি তালগাছ ও দুটি নারিকেল গাছ লাগানো ছিল অন্যতম। তিনি এসব শর্ত মেনে চলছেন বলে প্রবেশন অফিসার আদালতে রিপোর্ট দিয়েছেন। এপিপি অ্যাডভোকেট ভীম সেন দাস বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
যশোর আদালতের এই বিজ্ঞ এপিপি বলেন, যশোর আদালত থেকে গেল এক বছর এক মাসে ১২২ জনের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তারা আদালতে দোষ স্বীকার করেন। বিচারক তাদের সংশোধনের জন্য সুযোগ দিয়েছেন। তিন মাস পরপর প্রবেশন অফিসার তাদের বিষয়ে প্রতিবেদন দেন। প্রবেশনে মুক্তি দেয়া কারো বিষয়ে এখনো খারাপ রিপোর্ট আসেনি। আদালতের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে অনেকের জীবন বদলে যাচ্ছে। তারা পরিবারে থেকে ভালো হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। পাবিবারের স্বজনদের দেখভালও করতে পারছে।
এ বিষয়ে যশোরের প্রবেশন অফিসার আব্দুল ওহাব জানান, যশোর আদালত থেকে গত ২০ বছরে প্রবেশনে মুক্তি পেয়েছেন ১৩৯ জন। যাদের বেশিরভাগই শর্ত মেনে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করে চলেছেন বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের পক্ষে তিন মাস অন্তর প্রতিবেদনও দেন যশোর জেলা প্রবেশন অফিসার আব্দুল ওহাব। তিনি বলেন, গেল দুই দশকে প্রবেশনে মুক্তি প্রাপ্ত ১৩৯ জনের মধ্যে ১২২ জনই পেয়েছেন গত ১৩ মাসে। করোনা শুরু হলে এ বিষয়টি নিয়ে আদালত বেশি নজর দেন।
তিনি আরো বলেন, প্রবেশনে মুক্ত প্রাপ্ত সকলেই রাতারাতি সব কাজ ভাল করে ফেলবেন, নিজেরা ভালো হয়ে গেছেন এমনটা নয়। তবে তাদের ধারাবাহিক উন্নতি ও ভালো কাজের অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করে আদালতে প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে। হাকিমের হুকুমে তারা ভালোভাবে জীবনযাপন করছেন।