ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা
নিজস্ব প্রতিবেদক
২০২৪ সালের ২১ ডিসেম্বর। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের গাজীরদরগাহ এলাকা। এসপি গোল্ডেন লাইনের একটি যাত্রীবাহী বাসের চাপায় এক পথচারী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বাসটিকে স্থানীয়রা আটক করে। পরে সেখানে উপস্থিত হয় নাভারণ হাইওয়ে থানা পুলিশ। আইনগত ব্যবস্থা নিতে গেলে হাইওয়ে পুলিশকে কোনো প্রকার ব্যবস্থা নিতে দেয়নি স্থানীয় প্রভাবশালীরা। সেখানে একপ্রকার নিরুপায় হয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয় পুলিশ। ফলে ক্ষতিপূরণের আশায় ভুক্তভোগী পরিবারটি এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। ক্ষতিগ্রস্ত বাসটিও সেই থেকে গাজীর দরগাহ ফিলিং স্টেশনের সামনে পড়ে আছে। জানাচ্ছিলেন নাভারণ হাইওয়ে পুলিশের ওসি রোকনুজ্জামান।
অপর ঘটনা ২২ এপ্রিলের। মহাসড়কের লাউজানি রেল ক্রসিংয়ের উপর একটি পিকআপের ধাক্কায় বেশ কয়েকজন ভ্যান আরোহী গুরুতর আহত হন। খবর পেয়ে ঘটনা স্থলে গিয়েও প্রভাবশালীদের বাধায় পিকআপটি আটক করে থানায় নিয়ে আসতে পারেনি পুলিশ। স্থানীয়ভাবে বিষয়টি সমাধান করা হবে এমন কথা বলে পিকআপের চালককে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন তারা। অভিযুক্ত পিকআপটিতে খুঁজতে গিয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতার শিকার হন ওসি রোকনুজ্জামান। ফোনো একটি দলীয় পরিচয়ে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলাসহ ‘দুই মাসের মধ্যে ট্রান্সফার করে দেওয়া হবে’ বলেও হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় আহতরা সামান্য চিকিৎসার খরচ পাননি বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।
শুধু এ ঘটনাই নয়। যশোরে প্রতিনিয়তই পুলিশের সঙ্গে চলছে এমন অহরহ ঘটনা। এমনকি পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে। যার সর্বশেষ ভুক্তভোগী চৌগাছা থানা পুলিশ। গত ৬ মে মাকাপুর গ্রামে কৃষকের ধান লুটের মামলার আসামি ধরতে গিয়ে থানার ওসি আনোয়ার হোসেনসহ পুলিশের সাত সদস্য হামলার শিকার হয়েছেন। আহত পুলিশ সদস্যরা জানান, আসামি ধরতে থানার এসআই মেহেদী হাসান মারুফ ও এসআই উত্তমের নেতৃত্বে তারা মাকাপুর গ্রামে যান। তারা সিয়াম নামে এক আসামিকে গ্রেফতার করেন। এ সময় স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতকারী আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে ওসি আনোয়ার হোসেন অতিরিক্ত ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। এরপর আসামিকে নিয়ে ফেরার পথে দুষ্কৃতকারীরা ফের ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে। গুরুতর আহত এএসআই লাভলুকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
গত ৫ মে বিকেলে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের বাকুলিয়া গ্রামে প্রেমের টানে পালিয়ে আসা অপ্রাপ্তবয়স্ক এক কিশোরীকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারধরের শিকার হন যশোর কোতোয়ালি থানার তিন পুলিশ সদস্য। আহতরা হলেন, এএসআই তাপস কুমার, কনস্টেবল রাবেয়া খাতুন ও ফারজানা খাতুন। থানায় অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুপুরে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাসে যশোর কোতোয়ালি থানার ৪ পুলিশ সদস্য, মেয়ের বাবা ও ভাই কালীগঞ্জ উপজেলার বাকুলিয়া গ্রামে মেয়েটিকে উদ্ধারে যান। এ সময় হামলার শিকার হন পুলিশ সদস্যরা। পরে কালীগঞ্জ থানা পুলিশের সহযোগিতায় তাদের উদ্ধার করা হয়। এ দুটি ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এর আগে গত ১ মার্চ সন্ধ্যায় যশোর শহরের দড়াটানায় ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে মোটরসাইকেল রাখতে নিষেধ করায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্য শরিফুল ইসলামকে ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দেন যশোর সিটি কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সবুজ হোসেন শাওন। এ ঘটনার পর অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০ মার্চ যশোরে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে আটক এক কিশোরকে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানা চত্বরে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মারধরের চেষ্টা করে একদল বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী। অপরদিকে শার্শার গোড়পাড়া এলাকায় টিসিবির পণ্য বিতরণ নিয়ে স্থানীয় ফাঁড়ির পুলিশের ওপড় চড়াও হয় স্থানীয়রা।
মাঠ পর্যায়ের একাধিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশের ওপর আলাদা ক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোনো অন্যায়কারীকে আইনের আওতায় আনতে গেলেই পুলিশের সঙ্গে ৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে উত্তেজিত হচ্ছেন। যার সুযোগ নিচ্ছে চিহ্নিত অপরাধীরা। পাশাপাশি জনসাধারণের আইন মানার প্রবণতাও কমে গেছে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে যশোর শহরের এক বাসিন্দা বলেন, যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে যশোর শহর। সন্ধ্যার পর শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কে যানজট লেগেই থাকে। মাঝেমধ্যে তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তখন মনে হয় কোথাও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই। কেউ কারও কথা শুনে না, মানে না। কোনো কারণে কাউকে কিছু বলতে গেলেই মারমুখী হচ্ছে। পুলিশের সামনেও এমন অনেক তর্কবিতর্ক বা মারামারির ঘটনা দেখছি, কিন্তু সেখানেও পুলিশ নীরব ‘দর্শক-শ্রোতা’।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) নূর-ই-আলম সিদ্দিকী দৈনিক কল্যাণকে বলেন, পুলিশ সদস্যদের মনোবল কমেনি। অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিবেদন এখনও পাইনি। খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।