জাহিদ হাসান
দুর্নীতির অভিযোগে যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোল্লা আমির হোসেনসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে বিদায়ী বছর মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে যশোর সদরের সাবেক সাব রেজিস্ট্রার শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সাবেক ওসি আবুল হাসেম খানের বিরুদ্ধে করা হয় মামলা। দুর্নীতির অভিযোগে গেল বছর এভাবে ২২টি মামলা করেছিল দুদকের সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়। মামলার ৭০ আসামির মধ্যে বেশির ভাগই সরকারি কর্মকর্তা। গেল বছরে ২১ অভিযানে ২২ মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে ৮ মামলার চার্জশিট হয়েছে। ৭ মামলায় জড়িতরা সাজা পেয়েছে।
দুদক মতে, গেল বছরের ডিসেম্বরে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে যশোর সদরের সাবেক সাব রেজিস্ট্রার শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। দুদকের সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজাহারে তার বিরুদ্ধে দুদকে ১ কোটি ৩১ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করে দুদকে মিথ্যা তথ্য প্রদান এবং ১ কোটি ২৭ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ নিজ দখলে রাখার অভিযোগ আনা হয়। মো. শাহজাহান আলী সাব রেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরি করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে তার নামে এই সম্পদ অর্জন করে নিজ দখলে রেখেছেন। তিনি বর্তমানে অবসরে রয়েছেন।
আসামিদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমির হোসেন, সাবেক সাব রেজিস্ট্রার শাহজাহান আলী ও তার স্ত্রী, ঝিনাইদহ ডিবির সাবেক ওসি আবুল হাসেম, যবিপ্রবির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আব্দুর রশীদ ও লোহাগড়ার কাশিপুরের ইউপি চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান উল্লেখযোগ্য
চাকরিতে দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ উঠেছে ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সাবেক ওসি মো. আবুল হাসেম খানের বিরুদ্ধে। এসব সম্পদের খোঁজ পেয়ে গেল বছর দুর্নীতি দমন কমিশন আবুল হাসেম খান ও তার স্ত্রী মাহফিজা বেগম চম্পার নামে মামলা হয়। পরে মাহফিজা বেগম চম্পার নামে আদালতে অভিযোগপত্রও দেয় দুদক। ওসি হাসেমের বিরুদ্ধে মামলা ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়, যশোর শহরের বারান্দি মৌজায় ওসি হাসেমের নামে ১০ শতক জমি, মণিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুর মৌজায় সাড়ে ৭ শতক জমি, কচুয়া মৌজায় ৫ দশমিক ৪০ একর জমি রয়েছে। এসব জমির অনেকাংশ তিনি পৈতৃক সূত্রে পাওয়ার কথা বললেও দলিল দেখাতে পারেননি। এ ছাড়া ওসি হাসেম ও তার স্ত্রীর যৌথ নামে যশোর শহরের বারান্দি মৌজায় ২৭ শতক জমির ওপর চার তলা বাড়ি ও একটি নির্মাণাধীন বাড়ি রয়েছে। মণিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুর মৌজায় তাদের দুইজনের নামে ২৮ দশমিক ১২ শতক জমিতে একটি একতলা পাকা বাড়ি ও সেমি পাকা তিনটি বাড়ি রয়েছে। মার্চে কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোল্লা আমির হোসেনসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। কমিশনের যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মাহফুজ ইকবাল এ মামলা করেন। আসামিরা হলেন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মোল্লা আমির হোসেন, সহকারী সচিব (কমন সার্ভিস) জাহাঙ্গীর আলম ও আশরাফুর ইসলাম, নিরাপত্তা অফিসার মনির হোসেন, উপ সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন, ক্রীড়া অফিসার আ ফ ম আসাফুদৌলা, অডিট অফিসার আব্দুস সালাম, হিসাব অফিসার মিজানুর রহমান ও জাহানারা খাতুন এবং সিস্টেম অ্যানালিস্ট শরিফ সালমা কহিনুর। তারা সবাই ওই কেনাকাটা কমিটির সদস্য ছিলেন বলে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বোর্ডের ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কম্পিউটার, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ ও প্রিন্টার কিনতে তিন কোটি ১৬ লাখ ২৮ হাজার ৩৫৬ টাকা ব্যয় করা হয়। দুদক তা যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধান করে জানায়, ওই কেনাকাটায় বাজারমূল্যের চেয়ে আসামিরা অতিরিক্ত এক কোটি ২০ লাখ ১৪ টাকা ব্যয় করেন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক
আব্দুর রশীদ ডিপ্লোমা ইন কমার্স (এইচএসসি সমমান), বি.কম. এবং এম.কম. পাস। তবে ২০১০ সালে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি গ্রহণের সময় ওই তিনটি সনদের পাশাপাশি তিনি অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে এলএলবির একটি সনদ জমা দেন। তার জালায়াতির তদন্ত করে দুদক। যা গেল বছরের জুলাইতে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তিনি বর্তমানে পিআরএল এ রয়েছেন। ১৯ মে ভিজিএফের চাল আত্মসাতের অভিযোগে নড়াইলের লোহাগড়ার কাশিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের বিরদ্ধে মামলা করে দুদুক। ইজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঈদুল আজহা উপলক্ষে দুস্থ মানুষের জন্য ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ২ হাজার ৭৭০টি কার্ডের বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৪১ দশমিক ৫৫০ টন চাল। চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বরাদ্দ গ্রহণ করে ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট ২৪ মেট্রিক টন চাল লোহাগড়া খাদ্যগুদাম থেকে উত্তোলন করেন। তার ইউনিয়নের গুদামে চাল রাখার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার অজুহাতে তিনি ১৭ দশমিক ৫৫০ মেট্রিক টন চাল খাদ্যগুদামে রেখে আসেন। ওই দিনই চাল উত্তোলনের সময়সীমা ছিল। ওই চাল থেকে পরদিন খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা কামরান হোসেন ৩ দশমিক ৬ মেট্রিক টন চাল চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের সঙ্গে যোগসাজশে চাল ব্যবসায়ী শাহাবুর রহমানের কাছে বিক্রি করেন, যার মূল্য ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৫৩ টাকা। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে। এছাড় জ্ঞাত আয় বহির্ভূত টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেনাপোলে কাস্টম কর্মকর্তা দেবাশীর্ষ কুন্ডু ও তার স্ত্রী লতিকা কুন্ডুকে আসামি করে মামলা করে দুদক। এছাড়া দুদকের মামলার তালিকায় শীর্ষে সরকারি কর্মকর্তারা।
এই বিষয়ে যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুদকের উপ পরিচালক আল আমিন বলেন, ‘অভিযোগ পেলেই আমরা তদন্ত করেছি। তদন্ত অনুযায়ী রিপোর্ট জমা দিয়ে আদালত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনছে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নজরদারিতে রাখাও হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে তারা।