নিজস্ব প্রতিবেদক
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ (এমএম কলেজ)। এ কলেজে দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে আটকে আছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের দাবি জানালেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ছাত্র সংসদের জন্য সোচ্চার হয়েছেন এমএম কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা এখন এমএম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জোর দাবি তুলছেন।
শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অনেক শীর্ষ নেতা কিংবা প্রয়াত অনেক জাতীয় নেতা এ কলেজ থেকে তাদের সোনালি রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্র সংসদ না থাকার ফলে শিক্ষাঙ্গনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ছাত্র সংসদ পুনরায় চালু হলে শিক্ষার্থীরা নতুন নেতৃত্বের সুযোগ পাবে এবং গণতান্ত্রিক চর্চার ঐতিহ্য ফিরে আসবে।
১৭ সেপ্টেম্বর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছি। এবিষয়ে খুব বেশি কিছু বলতে পারছি না। আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন সাধারণ শিক্ষার্থীদের। কলেজের একাডেমিক কাউন্সিল আছে, ছাত্র সংগঠক ও শিক্ষার্থীদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো।
-এসএম শফিকুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, সরকারি এমএম কলেজ
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংগঠনিক চর্চা ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরও।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, যশোর এমএম কলেজে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৮১ সালে। নির্বাচনে আব্দুল কাদের ভিপি ও মাহবুব আলম জিএস নির্বাচিত হন। গঠনতন্ত্রে এ কলেজে শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে শুধু ভিপি, প্রোভিপি ও জিএস পদে নির্বাচনের কথা বলা আছে। অন্যান্য পদ পূরণ করা হতো ক্লাস প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে। শুরু থেকে এ প্রক্রিয়ায় ছাত্র সংসদ গঠন করা গেলেও পরবর্তীতে কলেজের পরিসর বেড়ে যায়। বেড়ে যায় শ্রেণি ও শিক্ষার্থীর সংখ্যাও।
বর্তমানে এ কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি ছাড়াও ১৯টি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চালু রয়েছে। এ অবস্থায় কলেজে ক্লাস প্রতিনিধি মনোনয়নই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তাই শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গত শতাব্দীর আশির দশকে সরাসরি ভোটের মাধ্যমেই সব পদ পূরণের দাবি ওঠে। সে দাবির কোনো সুরাহা করা হয়নি, আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়নি।
পুঁথিগত বিদ্যার্জন বা শ্রেণিকক্ষের সিলেবাসভিত্তিক পড়াশোনায় ডুবে থাকাই উচ্চশিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য নয়। উচ্চশিক্ষা পরিপূর্ণ করার জন্য দরকার কিছু অনুষঙ্গের। অনুষঙ্গগুলোর অধিকাংশই পূরণ করে ছাত্র সংসদ। তাছাড়া ছাত্র সংসদ হলো গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম পরিচায়ক।
— মাহমুদ হাসান বুলু, আহ্বায়ক, এমএম কলেজ এক্স-স্টুডেন্ড এসোসিয়েশন
অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮২ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ শরীফ হোসেন সংবিধান পরিবর্তনের জন্য গণভোটের আয়োজন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই গণভোটটি ভেস্তে যায়। ফলে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে এ নিয়ে কলেজ প্রশাসন আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
ছাত্র সংসদের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে জোরালো আন্দোলন গড়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত তা মুখ থুবড়ে পড়ে।
কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক শেখ হাসান ইমাম বলেন, ‘বিগত সময়ে ক্যাম্পাসকে নিজেদের মতো ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। আমরা সব সময়ই চাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক। ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী সমৃদ্ধ এমএম কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া সময়ের দাবি। তবে আমরা এমন নির্বাচন চাই না, যা প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
তিনি আরও বলেন, ৯০ দশকে প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ চালু থাকায় জাতীয় রাজনীতিতে ত্যাগী ও দেশপ্রেমী নেতা উপহার দিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ চালু না থাকায় বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে ব্যবসায়ী ও আমলাদের পদচারণা দেখা যাচ্ছে।
কলেজ ছাত্রশিবিরের সভাপতি রাসেল ফারহান বলেন, গত একবছরে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলিনি। তবে বিভিন্ন সময় আমরা অধ্যক্ষ বা বিভিন্ন শিক্ষকদের কাছে ছাত্র সংসদের বিষয়ে কথা বলেছি।
বিগত সময়ে ক্যাম্পাসকে নিজেদের মতো ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। আমরা সব সময়ই চাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক। ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী সমৃদ্ধ এমএম কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া সময়ের দাবি।
-শেখ হাসান ইমাম, আহ্বায়ক, কলেজ ছাত্রদল
এমএম কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থবর্ষের শিক্ষার্থী ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম আল ফাত্তাহ বলেন, শিক্ষা একটি ব্যক্তি বা সমাজকে আলোকিত করে আর রাজনীতি সঠিকভাবে পরিচালনা করায়। তাই প্রত্যেককে রাজনৈতিক সচেতন হওয়া জরুরি। আর রাজনৈতিক সচেতন হওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি। কিন্তু এদেশের তরুণ সমাজ রাজনীতি বিমুখ। কেননা এরা আশেপাশের লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি চর্চা প্রত্যক্ষ করে। এসব দেখে ছাত্ররা রাজনীতিকে ভয় হিসেবে নেয়। শিক্ষার্থীদের রাজনীতি সচেতন করার একমাত্র পন্থা হচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এমএম কলেজে বর্তমানে ত্রিশ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। তাই এমএম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া জরুরি।
তিনি আরও বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বেশ কয়েকবার অধ্যক্ষের কাছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি করেছিলাম। কিন্তু একবছরে কলেজে বেশ কয়েকজন অধ্যক্ষ পরিবর্তন হয়েছে। এজন্য স্থায়ী কোন সমাধান নিয়ে আলোচনা করতে পারছি না।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। এমএম কলেজ এক্স-স্টুডেন্ড এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও সাবেক ছাত্র সংসদ নেতা মাহমুদ হাসান বুলু বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য সংবিধান সংশোধনের একটা বিষয় আছে। বিভিন্ন সময় সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তবে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
গত একবছরে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলিনি। তবে বিভিন্ন সময় আমরা অধ্যক্ষ বা বিভিন্ন শিক্ষকদের কাছে ছাত্র সংসদের বিষয়ে কথা বলেছি। আমরা চাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক।
-রাসেল ফারহান, সভাপতি, এমএম কলেজ ছাত্রশিবির
ছাত্র সংসদ নির্বাচন চান তিনি। বলেন, পুঁথিগত বিদ্যার্জন বা শ্রেণিকক্ষের সিলেবাসভিত্তিক পড়াশোনায় ডুবে থাকাই উচ্চশিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য নয়। উচ্চশিক্ষা পরিপূর্ণ করার জন্য দরকার কিছু অনুষঙ্গের, যা একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মানবিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক গুণের বিকাশ ঘটায়। এ অনুষঙ্গগুলোর অধিকাংশই পূরণ করে ছাত্র সংসদ। তাছাড়া ছাত্র সংসদ হলো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম পরিচায়ক। এটা এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার কোনো একক রাজনৈতিক ব্যানার নেই।
ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, কলেজে শিক্ষার্থীদের অসংখ্য সমস্যা রয়েছে। লাইব্রেরিতে বইয়ের স্বল্পতা, শ্রেণিকক্ষে নানা সঙ্কট। এসবের দিকে ঠিকমতো নজর দেওয়া হয় না। ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ থাকলে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দিয়ে আমাদের এ ন্যায্য দাবিসমূহ পূরণ করা সহজ হতো।
এদেশের তরুণ সমাজ রাজনীতি বিমুখ। কেননা তারা আশেপাশের লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি চর্চা প্রত্যক্ষ করে। এসব দেখে ছাত্ররা রাজনীতিকে ভয় হিসেবে নেয়। শিক্ষার্থীদের রাজনীতি সচেতন করার একমাত্র পন্থা হচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
–ফাহিম আল ফাত্তাহ, এমএম কলেজ শিক্ষার্থী ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা
কলেজের কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ফরম ফিলাপ করে পরীক্ষা দিতে আসে। অধিকাংশই ক্লাস করতে আসে না। যাদেরকে দেখা যায়, তারাও সীমিত কয়েকজন। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে দুই-একজন নিয়ে কাজ চালানো হয়। তাই বর্তমানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাওয়ার লোকের অভাব রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এক সময় শহরের বিভিন্ন সুধীজন, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, শিক্ষকদের একাংশের সঙ্গে বাম সংগঠনগুলো নির্বাচনের জোরালো দাবি তুলেছিল। তবে কলেজ ক্যাম্পাসে এসব নিয়ে বিশৃঙ্খলা হওয়ায় সামনের দিকে এগোয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, সিনিয়র হিসেবে ১৭ সেপ্টেম্বর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছি। এবিষয়ে খুব বেশি কিছু বলতে পারছি না। আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন সাধারণ শিক্ষার্থীদের। কলেজের একাডেমিক কাউন্সিল আছে, ছাত্র সংগঠক ও শিক্ষার্থীদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো।