
এহসান-উদ-দৌলা মিথুন
ডিসেম্বর এলেই যশোরের বাতাসে ফিরে আসে বারুদের গন্ধ,রক্তের ইতিহাস আর বিজয়ের গৌরব। ৬ ডিসেম্বর-এই একটি তারিখ যশোরের মানুষের কাছে শুধু একটি দিন নয়, এটি একটি জাতির বুক ফাটানো সংগ্রামের বিজয়ক্ষণ। ১৯৭১ সালের এই দিনেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয়ের লজ্জা বুকে নিয়ে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায়। শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা। আকাশে ওড়ে বিজয়ী বাংলাদেশের রক্তসূর্যখচিত গাঢ় সবুজ পতাকা।
সেদিন যশোর শুধু মুক্ত হয়নি-মুক্ত হয়েছিল হাজারো নির্যাতিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস,বন্দিদশায় থাকা স্বপ্নগুলো, আর মায়ের কোল খালি করা সন্তানের আত্মত্যাগ।
বিজয়ের পেছনের রক্তাক্ত পথ :
এই বিজয় এক দিনের যুদ্ধের ফল নয়। এর পেছনে আছে নয় মাসের রক্ত, কান্না, আগুন আর অগণিত শহীদের আত্মদান। স্বাধীনতার প্রথম শহীদ চারুবালা করের রক্তে যে পথ রঞ্জিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ, সেই রক্তের ওপর দিয়েই এগিয়েছে যশোরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিকামী জনতার সেই জঙ্গি মিছিলে পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন চারুবালা কর-স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তার পর থেকেই যশোর হয়ে ওঠে প্রতিবাদের অগ্নিকুণ্ড।
২৬ মার্চ পাকবাহিনীর বর্বরতা ছুঁয়ে যায় চরম নিষ্ঠুরতার সীমা। তদানীন্তন জাতীয় সংসদ সদস্য মশিয়ুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যশোর সেনানিবাসে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ২৯ মার্চ পাকবাহিনী যশোর শহর ছেড়ে সেনানিবাসে সরে যায়। পরদিন ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ আরও অনেক সাহসী সেনা।
৩০ ও ৩১ মার্চ মুক্তিকামী জনতা মিছিল সহকারে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলা চালায়। ভেঙে যায় কারাগারের তালা-মুক্তি পায় সব রাজবন্দি। জুলাই মাস থেকে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের নতুন অধ্যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা শহর ও বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোতে একের পর এক ভয়াবহ হামলা চালাতে থাকে।
৮ নম্বর সেক্টর ও বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ :
যশোর ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। প্রথম দিকে এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী, পরে কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর মঞ্জুর। এই সেক্টরের ইতিহাস রক্তে লেখা।
যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে ৫ সেপ্টেম্বর শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ। তার আত্মত্যাগ যশোরের মাটিকে করে তোলে আরও পবিত্র, আরও গর্বের।
চৌগাছা থেকে মনোহরপুর-বিজয়ের দিকে অগ্রযাত্রা :
২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলের লক্ষ্যে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি চৌগাছা ঘিরে ফেলে সম্মিলিত বাহিনী। জগন্নাথপুর ও সিংহঝুলির ভয়াবহ যুদ্ধের পর ২২ নভেম্বর রাতে চৌগাছা শত্রুমুক্ত হয়। এসব যুদ্ধে পরাজয়ের পর পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে।
ডিসেম্বরের শুরুতে যুদ্ধ পৌঁছে যায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ২ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী যশোর সীমান্তে চৌগাছা ও শার্শায় অবস্থান নেয়। ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর সীমান্তজুড়ে চলে ভয়াবহ যুদ্ধ। মুহুর্মুহু বোমা আর বিমান হামলায় কেঁপে ওঠে যশোর। ৫ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে চৌগাছা সীমান্ত থেকে দেখা যায় আগুনের লেলিহান শিখা-যেন আগুনেই পুড়ছে শত্রুর পরাজয়।
৫ ডিসেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্টের কাছের মনোহরপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তুমুল লড়াইয়ের একপর্যায়ে পাক সেনারা অস্ত্র ফেলে পিছু হটে সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়।
৬ ডিসেম্বর-বিজয়ের সকাল :
শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী যশোর ছেড়ে পালিয়ে যায় খুলনার দিকে। ইতিহাসের একটি অধ্যায় তখনই বদলে যায়। শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত যশোর কালেক্টরেট ভবনের ওপর যখন স্বাধীন দেশের পতাকা উড়ল, তখন যশোরবাসীর চোখে তখন আনন্দের জল, বুকভরা গর্ব আর শহীদদের জন্য নিঃশব্দ কান্না। মুক্তিযোদ্ধা আর মিত্রবাহিনীর সদস্যরা যশোরের মানুষকে উপহার দেন এক বিরল সম্মান-স্বাধীনতার আলো।
শহীদদের রক্তে লেখা এই শহর :
যশোর আজ যে মুক্ত, উন্নত ও আলোকিত-এই আলোর পেছনে জ্বলছে হাজারো প্রদীপ, যেগুলোর আগুন জ্বালিয়েছে শহীদদের রক্ত। ৬ ডিসেম্বর তাই শুধু উৎসবের নয়, এটি আত্মসমালোচনার, আত্মগর্বের এবং দায়বদ্ধতার দিন।
এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়-
স্বাধীনতা উপহার নয়, এটি ত্যাগের ফসল।
যশোর মুক্ত দিবস মানে-চারুবালা কর থেকে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, লেফটেন্যান্ট আনোয়ার থেকে অগণিত নাম না-জানা শহীদের চিরন্তন শ্রদ্ধা।
হে মুক্ত যশোর-তোমার বিজয় চির অম্লান থাকুক,
শহীদদের রক্তে লেখা এই স্বাধীনতা থাকুক অটুট।
হল মাঠ।”
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক,দৈনিক কল্যাণ
