দেলোয়ার কবীর, ঝিনাইদহ
৭০ কোট টাকা লোকসান আর সাড়ে ৩শ কোটি টাকা ব্যাংকের দায় মাথায় নিয়ে ৫৮তম মাড়াই মৌসুমের যাত্রা শুরু করেছে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে অবস্থিত মোবারকগঞ্জ চিনিকল। শুক্রবার বিকালে মিলের ডোঙ্গায় আখ ফেলে উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের ইক্ষু গবেষণা বিভাগের পরিচালক যুগ্ম সচিব এটিএম কামরুল ইসলাম। রাষ্ট্রীয় মালিকানার এ চিনিকলে প্রতি কিলোগ্রাম চিনি উৎপাদনে খরচ হয় ৫৪২ টাকা। যেটি অবিশ্বাস্য হলেও নিরেট সত্যি। গত মাড়াইমৌসুমে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও ব্যাংকের সুদ গুণে এ উৎপাদন খরচ পড়ে। প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে ৪১৭ টাকা লোকসান পড়েছে বলে চিনিকলের একটি সূত্র জানায়।
সূূত্র মতে, ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌসুমে এই চিনিকলের চিনি আহরণের হার ছিল সর্র্বনি¤œ। ওই বছর ২৫শ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে ১৮শ ৭১টন। ওই সময়ে চিনিকলে অপারেশনাল লোকসান হয়েছে ৩৪ কোটি টাকা আর ব্যাংকের ঋণ বাবদ সুদ দিয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। ১৯৬৫ সালে নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় কালিগঞ্জ শহরের নলডাঙ্গায় ২০৭ একর নিজস্ব জমির ওপর ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ২০ দশমিক ৬২ একরে কারখানা, ৩৮ দশমিক ২২ একরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন, ২৩ দশমিক ৯৮ একরে পুকুর, ১০৭ একরে আখের খামার এবং ১৮ দশমিক ১২ একরে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। চিনিকলের ঊষালগ্নে পরীক্ষামূলক ৬০ কর্মদিবসে আখমাড়াই করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে ১৯৬৭-৬৮ মাড়াইমৌসুম থেকে বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু করে। ঝিনাইদহ সদর, শৈলকুপা, কালিগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, সীমান্তবর্তী মহেশপুর ও হরিণাকুন্ডু উপজেলা ছাড়াও যশোরের দুই উপজেলা নিয়ে ৮টি জোন এলাকায় ১৮ দশমিক ১২ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সাবজোন অফিস আর আখ ক্রয় কেন্দ্র। এই ৮ জোনে জমির পরিমাণ হলো সাড়ে ৩ লাখ একর এরমধ্যে ৩ লাখ একর জমি আবাদযোগ্য।
চিনিকল চালু রেখে উপাদনে গেলে ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি টাকা আর বন্ধ রাখলে শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বাবাদ বছরে ৮ কোটি টাকা লোকসান গুণতে হবে। এত চিনিকল চালু রাখার চেয়ে বন্ধ রাখাই সরকারের জন্য শ্রেয় বলে উর্ধতন কর্মকর্তারা মনে করেন।
চিনিকলের আধুনিকায়নের পাশাপাশি আখের উৎপাদন বাড়াতে চাষিদের সার, বীজ ইত্যাদি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, তাদের মধ্যে সচেতনতা কর্মসূচি জোরদার করা এবং প্রয়োজনীয় প্রণোদনা বহাল রাখা জরুরি।
মোবারকগঞ্জ চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক হিরন্ময় বিশ^াস জানান, চলতি মাড়াইমৌসুমে ৭০ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৯২০ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে যেখানে চিনি অহরণের হার হবে ৫ দশমিক ৬ ভাগ। মহাব্যবস্থাপক জানান, গত মাড়াইমৌসুমে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৩শ ৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। চিনকলের কর্মচারীদের বেতনভাতা, আয়কর, ও ব্যাংকের সুদ হিসেবে করলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। ১৯৬৫ সালের সেই পুরনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই উৎপাদন চালু রয়েছে। যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি দীর্ঘ ৬০ বছরেও। বৃটিশ আমলের সব পুরনো যন্ত্রপাতি মেরামত ও ব্যবস্থাপনা খরচ বাবদ ফিবছরই বেড়ে চলেছে জ¦ালানি ও অন্যান্য খরচ। এসব কারণে লোকসানের বোঝা না কমে বরঞ্চ বাড়ছেই। অখচাষ হ্রাস পাওয়া বিষয়ে মহাব্যবস্থাপক বলেন, আখের জমিতে চাষিরা এখন বেশি লাভজনক ফুল, ড্রাগন, সবজি, কুল, পেয়ারা, লিচু ইত্যাদি চাষ করায় আখচাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না।
চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার জানালেন, নিঁচু এলাকার জমিতে উৎপাদিত আখে চিনি আহরণের হার কমে যায়। তাছাড়া, আখচাষিরা আখের ওজন বাড়ানোর লক্ষ্যে জমিতে উপুর্যপরি সেচ ও উপরি সার প্রয়োগ করেন। এতেও চিনি আহরণের হার কমে যায় সংগত কারণেই। তাদের মতে, চিনিকল চালু রেখে উপাদনে গেলে ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি টাকা আর বন্ধ রাখলে শ্রমিক-কর্মচারিদেও বেতন-ভাতা ইত্যাদি বাবদ বছরে ৮ কোটি টাকা লোকসান গুণতে হবে। তারা আরো মনে করেন, চিনিকলটি আধুনিকায়ন করে চালু রাখলে তা যেমন লাভের মুখ দেখতে পারবে, চিনিকলটি তার ঐতিহ্য ধরে রেখে হাজারো শ্রমিক-কর্মচারীর অন্নবস্ত্রের নিশ্চয়তাও দিতে পারবে। এজন্য এর আধুনিকায়নের পাশাপাশি আখের উৎপাদন বাড়াতে চাষিদের সার, বীজ ইত্যাদি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, তাদের মধ্যে সচেতনতা কর্মসূচি জোরদার করা এবং প্রয়োজনীয় প্রনোদনা বহাল রাখা জরুরি।
অন্যদিকে চিনিকল এলাকার কৃষকদের কথা হলো- মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও সিবিএ নেতোদের স্বেচ্ছাচারিতা ও লাগামহীন দুর্নীতি, কর্তব্যকাজে অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে ঐতিহ্যবাহী এ চিনিকল তার ঐতিহ্য হারিয়েছে বহু আগেই। ফলে প্রবিছরই বেতনভাতা ও অনুসঙ্গিক খাতে লোকসান গোনা বন্ধ হচ্ছে না। তাদের বক্তব্য হলো এসব কারণে চিনিকল এলাকার অধিকাংশ চাষিই আখচাষে আগ্রহ হারিয়েছেন। তারা আখের বদলে ভিন্ন সবজি ও ফলের আবাদ করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ। এ কারণে ঝিনাইদহের পশ্চিমাঞ্চলের বোড়াই, নারায়নপুর, কাশিমপুর, হলিধানি, ঝিনাইদহের গোপিণাথপুর এলাকার অ^াখক্রয় কেন্দ্রগুলো বহুবছর বন্ধ রয়েছে। এতে চিনিকল চালু রাখার চেয়ে বন্ধ রাখাই সরকারের জন্য শ্রেয় বলে তারা মনে করেন।