কল্যাণ ডেস্ক
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মুক্তি দাবিতে তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) লাখ লাখ সমর্থক গত সোমবার রাতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাজধানী ইসলামাবাদে হাজির হয়েছিল। ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবি তার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সমর্থকদের রাজধানীতে অবস্থান করতে বলেন। তবে ২৪ ঘণ্টাও রাজধানীতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে পারেনি তারা। অভিযানের মুখে বুধবার ভোর হওয়ার আগেই বুশরা বিবিও বিক্ষোভস্থল ত্যাগ করেন।
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে রবিবার থেকেই দেশজুড়ে পথে নেমেছিল পিটিআই নেতাকর্মীরা। এক পর্যায়ে ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবি ঘোষণা করেন, স্বামীকে মুক্ত না করে তিনি ঘরে ফিরবেন না। তারপর বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাজধানীর দিকে যাওয়া শুরু করে ইমরানের সমর্থকরা। আর সরকার ইসলামাবাদে লকডাউন জারি করে শহরে প্রবেশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়।
সোমবার সকাল থেকে ইসলমাবাদের চারপাশে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এক পর্যায়ে তারা রাজধানীতে ঢুকে পড়ে। মঙ্গলবার পিটিআই নেতাকর্মীরা নিরাপত্তাবাহিনীকে ঠেলে বিক্ষোভস্থল ইসলামাবাদের ডি–চকে পৌঁছে যায়।
কিন্তু মঙ্গলবার গভীর রাতে নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর অভিযান চালিয়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এই সংঘর্ষে পিটিআই কর্মীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। বিক্ষোভস্থলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে এই অভিযান চালানো হয়। স্থানটি রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রেড জোন (গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সরকারি ভবনের অবস্থান) থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে।
অভিযান শুরু হওয়ার পর বুধবার ভোর হওয়ার আগেই বুশরা বিবি ও খাইবার পাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রী আলি আমিন গান্দাপুর বিক্ষোভস্থল ত্যাগ করেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে। বুধবার সকালে পিটিআই এক বিবৃতিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। তারপরও পিটিআই সমর্থকরা খাইবার পাখতুনখোয়াসহ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই ইসলামাবাদে প্রবেশ করেছিল।
পিটিআই বলছে, গত ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তারা জয় পেলেও তা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বন্দিদের (যার মধ্যে ইমরান খানও আছেন) মুক্তি দিতে হবে। সাংবিধানিক সংশোধনী বাতিল করতে হবে, যার মাধ্যমে সরকারকে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিক্ষোভ প্রত্যাহারের পর পিটিআই নেতৃত্ব ব্যাপক চাপে পড়েছে। কারণ তাদের কোনও দাবিই পূরণ হয়নি এবং ভবিষ্যতে দল কীভাবে সংগঠিত হবে তাও স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জায়গাম খান আল জাজিরাকে বলেন, “এই প্রতিবাদ কর্মসূচিকে দলটির ‘চূড়ান্ত ডাক’ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়া তাদের রাজনৈতিক কৌশলের জন্য বড় ধাক্কা।”
পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর অভিযানের ফলে হতাহতের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া গেছে। পিটিআই দাবি করেছে, তাদের আটজন সমর্থক নিহত হয়েছেন। তবে সরকার গুলি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, কোনও বিক্ষোভকারী নিহতও হননি।
সরকারি কর্মকর্তারা জানান, সোমবার পিটিআইর মিছিল থেকে একটি গাড়ির চাপায় আধাসামরিক বাহিনী রেঞ্জারের তিন সদস্য নিহত হন। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে এক পুলিশ কনস্টেবলও মারা যান। ইসলামাবাদে গত চার মাসের মধ্যে এটি ছিল পিটিআইয়ের চতুর্থ বিক্ষোভ। এর আগে রাজধানীতে তারা সর্বশেষ সমাবেশ করে অক্টোবরে। আগের সমাবেশগুলোর মাধ্যমে দাবি আদায় করতে পারেনি দলটি।
বুধবার দুপুরে খাইবার পাখতুনখোয়ার মানসেহরা শহরে এক সংবাদ সম্মেলনে আলি আমিন গান্দাপুর সরকারের দমন অভিযানের নিন্দা জানান। পিটিআই তাদের দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে তিনি জানান দেন। ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরান খানের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর থেকেই পিটিআই আন্দোলন চালিয়ে আসছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পিটিআই সর্বাধিক আসনে জয়লাভ করলেও সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়। বিরোধীরা জোট বেঁধে সরকার গঠন করে ফেলে। পিটিআই দাবি করে, তাদের ম্যান্ডেট চুরি করা হয়েছে।
ইমরান খান ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে কারাবন্দি রয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অভিযোগে শতাধিক মামলা হয়েছে। তার স্ত্রী বুশরা বিবিও দুর্নীতির অভিযোগে নয় মাস কারাভোগ করেছেন। গত অক্টোবরে জামিনে মুক্তি পান তিনি। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নকভি ইসলামাবাদে অস্থিরতার জন্য বুশরা বিবিকে দায়ী করেছেন। মঙ্গলবার এ অভিযোগ করে তিনি বলেন, “গত কয়েকদিনে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পুরো দায় তার ওপরই পড়ে।”
পিটিআই নেতা সৈয়দ জুলফি বুখারি দলের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দল বর্তমানে হতাহতদের বিষয়েই মনোযোগ দিচ্ছে। তবে লাহোরভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেনজির শাহ বলেন, এই মুহূর্তে ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে আরেকটি বড় আন্দোলন শুরু করা পিটিআইয়ের জন্য বাস্তবসম্মত হবে না।
বেনজির শাহ আল জাজিরাকে বলেন, “পিটিআইকে তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হবে। একটি সম্ভাব্য পথ হতে পারে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জোট গঠন করা, যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগে একমত। সামাজিক ও মানবাধিকার ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদও জাতীয় পর্যায়ে সমর্থন বাড়াতে পারে।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারীদের হটাতে বেআইনি ও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের মুখপাত্র রানা ইহসান আফজাল অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, পিটিআই সমর্থকরা অস্ত্র বহন করছিল।
তিনি বলেন, “আমাদের পুলিশের শরীরে গুলির চিহ্ন রয়েছে, যা প্রমাণ করে বিক্ষোভকারীরা সশস্ত্র ছিল।” আফজাল বলেন, সরকার বারবার বিকল্প বিক্ষোভস্থলের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু পিটিআই ইসলামাবাদ হাই কোর্টের আদেশ লঙ্ঘন করে শহরে সমাবেশ করে।
“এটি কোনও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ছিল না। তারা সহিংসতা চেয়েছিল এবং তা ব্যবহার করে সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করেছে।” তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, পিটিআইয়ের বিক্ষোভে ব্যর্থতা তাদের নেতৃত্বে ঘাটতিরই লক্ষণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক তালাত হুসেইন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে দলটি যতটা সাড়া পেয়েছিল, বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “মঙ্গলবার রাতে পিটিআই বুঝেছে, রাজনীতি কেবল অনলাইনে সীমাবদ্ধ নয়।” ইসলামাবাদভিত্তিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক আহমেদ ইজাজ বুশরা বিবি ও আলি আমিন গান্দাপুরের আকস্মিক প্রস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, তাদের এই পদক্ষেপ দলের ভেতরে বিভাজন আরও গভীর করবে। ইজাজ বলেন, “ডি-চকে সমর্থকদের ছেড়ে যাওয়ার এই কৌশল দলের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নিয়ে পরিকল্পনা করার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।” তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেনজির শাহ বলেন, “সরকার হয়তো শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিক্ষোভ ঠেকানোর বার্তা দিতে চেয়েছে। তবে এই কঠোর পদক্ষেপ উল্টো ফল দিতে পারে। এটি সংলাপ বা উত্তেজনা প্রশমনে সরকারের ব্যর্থতার চিত্রই তুলে ধরছে।” ইসলামাবাদভিত্তিক বিশ্লেষক জায়গাম খান অবশ্য সরকারের এই প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত হননি। তিনি বলেন, “এই সরকার পাকিস্তানের সবচেয়ে অজনপ্রিয় সরকার।” গত নয় মাস ধরে শাহবাজ সরকারের ওপর কালো ছায়া ফেলা ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগের দিকেও ইঙ্গিত করেন তিনি।
জায়গাম বলেন, “ওই অভিযোগের কারণেই যেকোনো উদ্যোগ, যা তাদের স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত করতে পারে, তা তারা মেনে নিতে পারেনি এবং এতো কঠোরভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।”