- ভুল চিকিৎসা-রিপোর্ট নিত্য ঘটনা
- ভুয়া ডিগ্রিধারী আর নামসর্বস্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্র
- প্রশাসন ‘শুনতে’ পায় না বিপদগ্রস্তদের কান্না
জাহিদুল কবীর মিল্টন: ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যাপক লাভ। তাই যশোর জেনারেল হাসপাতালে সামনে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এগুলোর মালিক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যাপক চাকচিক্য থাকলেও হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশই চলছে অব্যবস্থাপনার মধ্যে।
ভুল চিকিৎসা ও ভুল রিপোর্ট নিত্য দিনের ঘটনা। এগুলো মূলত চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্য ও প্রতিষ্ঠান মালিকদের সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে অধিক মুনাফা লাভের কেন্দ্র। এর তদারকির দায়িত্ব যশোর স্বাস্থ্য বিভাগের অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ নিরব দর্শকের ভূমিকায়। যশোরের অধিকাংশ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অব্যবস্থাপনা চলছে। অভিযোগ উঠেছে ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে অসাধুরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু রোগী ও তাদের স্বজনদের দুর্ভোগের শেষ নেই। এ সব প্রতিষ্ঠানে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের তদারকি ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না থাকায় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা কোন নিয়মনীতি তোয়াক্কা করছেন না। সাধারণ মানুষ উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন। একই সাথে হচ্ছেন প্রতারিত। কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী চিকিৎসক সেজে রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। এসব কারণে ভুল চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে অনেকেই।
নামসর্বস্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্র
যশোর জেলায় অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামসর্বস্ব। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী বর্হির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ, অস্ত্রোপচার কক্ষ, চিকিৎসার যন্ত্র্রপাতি, পর্যাপ্ত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ইত্যাদি নেই। একাধিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ঘুরে এমনটা চোখে পড়েছে।
‘কয়েকটি ক্লিনিক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এ ধারা অব্যাহত থাকবে। আর হাসপাতালের
সামনে অবৈধ ক্লিনিকগুলোকে সরিয়ে
নেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হবে।’
-সিভিল সার্জন
ক্লিনিক স্থাপনায় অনিয়মসিভিল সার্জন অফিসের সূত্রমতে যশোরে বেসরকারি ক্লিনিক,হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিকের সংখ্যা ২৯১টি। এর মধ্যে ক্লিনিকি ও হাসপাতাল রয়েছে ১১২ টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১৭৯ টি। সরকারি নীতিমালা বা শর্তানুযায়ী ১০ শয্যার প্রতিটি ক্লিনিকের জন্য ২৪ ঘণ্টা ১ জন রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসক, ডিপ্লোমাধারী ২ জন সেবিকা, ৩ জন সুইপার ও ৮০০ বর্গফুট জায়গা থাকা বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি মনোরম পরিবেশে হাসপাতাল ক্লিনিক গুলো স্থাপন করতে হবে। অথচ এসব নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে তা ধরা পড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে কোন সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের ২শ’ গজের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন করা যাবে না। অথচ যশোরের ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল গেটের সামনেই স্থাপন করা হয়েছে অসংখ্য বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
যেভাবে চলছে
প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিক মানেই জনগণ ভেবে নেয়, চিকিৎসা সেবা, বেড, কেবিন, চলাফেরা সবই যেন ভিআইপি ভাব রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার সম্পূর্ণ উল্টো। সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্লিনিকে জায়গা সংকটে হাঁটা চলাও দায়। কোন কোন কক্ষে পাতানো হয়েছে ৫-৬ টি করে বেড। এখানে রোগী ও তাদের আত্মীয় স্বজন ঠাসাঠাসি করে থাকছেন। ছোট ছোট কক্ষে তৈরি করা হয়েছে কেবিন। কিন্তু নিয়ম রয়েছে রোগীর কক্ষ ও কেবিন ৬০ স্কয়ার ফিট হতে হবে। কোন প্রকার নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে পরিচালনা করা হচ্ছে ক্লিনিকের কার্যক্রম।
অপচিকিৎসা
এসব বেসরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অস্ত্রোপচার হলেও তেমন একটা যন্ত্রপাতি ও লোকবল নেই। সার্বক্ষণিক চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক রাখার নিয়ম থাকলেও অনকলে এনে চিকিৎসা বা অপারেশন করানো হয়। নি¤œমানের চিকিৎসার কারণে একের পর এক রোগী মারা যাবার ঘটনা ঘটছে অহরহ। যেমন জেলরোডের মাতৃসেবা হাসপাতালের মালিক ডা, মোজাম্মেল অপারেশন করতে গিয়ে এক প্রসূতিকে মেরে ফেলেন। এ ঘটনায় হাসপাতালটি বন্ধ করা হয়। এছাড়া স্ক্যান হাসপাতালে সিজার করতে গিয়ে নাজমা খাতুন নামে এক রোগীর খাদ্যনালী কেটে ফেলে। চিকিৎসকের অজ্ঞতায় অপারেশন থিয়েটারেও থেমে যাচ্ছে অনেক রোগীর প্রাণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞ রেডিওলজিস্ট ও সনোলজিস্ট নেই। আর্থিকভাবে লাভবান হতে প্রতিষ্ঠান মালিকেরা অনভিজ্ঞ রেডিওলজিস্ট ও সনোলজিস্ট ডেকে এনে কার্যক্রম পরিচালনা করে। রোগী আসলেই চিকিৎসকের কাছে ফোন করা হয়। এছাড়া ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক কর্তৃপক্ষ ভুয়া টেকনিশিয়ানের মাধ্যমে রিপোর্ট দিচ্ছে।
চিকিৎসকরা ক্লিনিকের মালিক
যশোর শহরের অধিকাংশ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের মালিক হলেন চিকিৎসকরা। বাণিজ্যিক স্বার্থে তারা নিজেরাই বেসরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র খুলে বসেছেন। যশোর শহরে কতিপয় চিকিৎসকের রয়েছে একাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল। অবাক ব্যাপার হলো যশোরের সাবেক সিভিল সার্জন দিলীপ কুমারের বাড়ির নীচে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাও আবার কেশবপুর সরকারি হাসপাতালের সামনেই। ক্লিনিকের নাম পেয়ারলেস ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এই ক্লিনিকের ওপরে সিভিল সার্জনের বাসভবন। এছাড়া প্রায় প্রতিসপ্তাহে বাড়ির সামনে মডার্ন হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী অপারেশন করেন।
ভুয়া ডিগ্রিধারীদের রাজত্ব
যশোরের বেসরকারি হাসপাতাল ও অধিকাংশ ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ভুয়া ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের দখলে রয়েছে। এমন চিকিৎসকের সংখ্যা শতাধিক। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমএন্ডডিসি) ওই সব চিকিৎসকদের নিষিদ্ধ করলেও তারা তোয়াক্কা করছেন না। চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ কার্যক্রম। অথচ অজ্ঞাত কারণে ভুয়া চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন। এদিকে কোন কোন ক্লিনিক ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে রাজধানী ঢাকার বড় বড় চিকিৎসকের সাইনবোর্ড টানানো থাকলেও বাস্তবে ওই চিকিৎসক সেখানে আসেন না। অথচ প্রতারণার মাধ্যমে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। কয়েক মাস আগে যশোরের সিভিল সার্জন অফিস থেকে ভুয়া ডিগ্রিধারী একাধিক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নোটিশ পাঠানো হয়। এর পরেও থেমে নেই তাদের কর্মকান্ড। যেমন বন্ধন ক্লিনিকে ভূয়া ডেন্টিস্ট আরিফুল ইসলাম এখনো কর্মরত। অভিযোগ উঠেছে, নোটিশ পাঠানোর পর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তার সাথে ভুয়া ডিগ্রিধারীদেও রফা হয়েছে।
নামেই বড় হাসপাতাল
আর্থিকভাবে লাভবান হতেই নামমাত্র বড় ধরণের বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। অথচ ভবনে নেই নির্দিষ্ট পরিমাণে জায়গা, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত পরিমাণে চিকিৎসা সরঞ্জাম, সেবিকা, কর্মচারী ও রোগীর শয্যা। বিগত দিনে পরিচালিত কোন এক ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম পাল্টে পরিচালনা করা হচ্ছে এই হাসপাতাল। প্রকাশ্যে এ ধরণের প্রতারণা চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব ভূমিকা পালন করছে।
টেস্টের ভার ও সমঝোতা ব্যবসা
রোগীরা চিকিৎসা সেবা নিতে আসলেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক রোগের বর্ণনা না শুনেই তার টিকিটে একাধিক টেস্টের নাম লিখে দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে জ্বরে আক্রান্ত রোগীকেও আলট্রাসনো করতে বলা হচ্ছে। চিকিৎসকের কমিশনের টাকার লোভের কারণে অসহায় রোগীরা প্রতারিত হয়ে প্রতিনিয়ত। গুনতে হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। চিকিৎসকের বাণিজ্য চুক্তির বিনিময়ে রোগীর সেবা প্রদান করা হয়। চিকিৎসক যখন রোগীকে দেখেন তখন মালিককে পার্সেন্টেজ দেন। আবার চিকিৎসকের দেয়া বিভিন্ন টেস্ট সেখান থেকে করার ফলে মালিক আবার ডাক্তারকে পার্সেন্টেজ দিয়ে থাকেন। ফলে ক্লিনিক মালিকও ডাক্তারের অর্থ হাসিলের জন্য সুস্থ মানুষকেও রোগী বানিয়ে দেয়া হয়। আবার এ দুই শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে আছে ছদ্মবেশী দালাল, যাদের কাজ রোগী ধরে ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেয়া। ওৎ পেতে থাকা দালালরা রোগীকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই কমিশন। যাদের কাছ থেকে মানুষের সেবা পাওয়ার কথা তারাই মানুষকে বোকা বানিয়ে দিচ্ছেন। এটাই হলো বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের হালচাল।
জনশ্রুতি রয়েছে, কোন বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে সিটিস্ক্যান করলে রোগী প্রতি চিকিৎসক কমিশন পান ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মান অনুযায়ী প্রত্যেক টেস্টেই রয়েছে চিকিৎসকের নির্দিষ্ট কমিশন চুক্তি। এছাড়া অধিকাংশ বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক না থাকলেও টেস্ট গ্রহণের মানুষের অভাব নেই। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সাধারণ রোগীদের বর্ণনাতীত দুর্ভোগ আর রমরমা বাণিজ্য। চোখে পড়ে টেস্টের জন্য লম্বা লাইন। কোথাও দেখা গেল ডাক্তার নেই আবার কোথাও দালালের ভিড়ে রোগীরা নিরূপায়। ডাক্তার না থাকলেও টেস্ট গ্রহণের মানুষের অভাব নেই। অদক্ষ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক নার্সকে দিয়ে চালানো হচ্ছে সেবা কার্যক্রম।
রক্ষক যখন ভক্ষক
যশোরের এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নানা সমস্যায় জর্জরিত হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সঠিকভাবে তদারকি ও জবাবদিহিতা না থাকায় অবৈধ প্রতিষ্ঠান মালিকেরা নিয়মনীতি মানছেন না। আবার অনেকেই বলেছেন রক্ষক অবর্তীণ হয়েছেন ভক্ষকের ভূমিকায়। ফলে স্বাস্থ্য প্রশাসন রয়েছে এক প্রকার ঠুটো জগন্নাথের মতো। এমন দুর্বলতার কারণেই কোন পদক্ষেপ নেই।
সিভিল সার্জনের বক্তব্য
যশোরের সিভিল সার্জন বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস বলেন, সম্প্রতি করোনা ধকল কেটে উঠলো। ইতোমধ্যে ঝিকরগাছার বাগআঁচড়ার আল মদিনা ক্লিনিক, বাঁকড়ার রয়েল প্যাথলজি, মণিরামপুর পারবাজারের কপোতাক্ষ ক্লিনিক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের সামনে অবৈধ ক্লিনিক গুলিকে আমরা চিঠি দেবো সরিয়ে নেয়ার জন্য। তবে এতে সময় লাগবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা কর্মচারী অবৈধভাবে স্থাপিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের মালিকদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেয়ার কারণে এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না। যে কারণে ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোয় অবৈধ কর্মকান্ড ও অপচিকিৎসা প্রকাশ্যে হচ্ছে।