রায়হান সিদ্দিক: যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় দু’তলা ভবনটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ১৭৮৬ সালে স্থাপিত হয় যশোর কালেক্টরেট ভবন। ১৭৮১ সালে জেলা ঘোষণার পর প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন টিলম্যান হেঙ্কেল। কালেক্টরেট নিজস্ব ভবন তৈরি হয় ১৮০১ সালে। ভবনটি শহরের দড়াটানায় অবস্থিত। এটি শহরের প্রাচীনতম স্থাপনার মধ্যে অন্যতম। ভবনের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ২০০ বছরের ইতিহাস।
বর্তমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয় নামে পরিচিত ভবনটি মনোরম করে সাজাতে বর্তমান জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান নিয়েছেন নানা উদ্যোগ।
দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত জেলা প্রশাসকের কক্ষে যাওয়ার জন্য সিড়ি বেয়ে উঠতে প্রথমেই চোখে পড়বে জাতীয় পাখি দোয়েলের সুন্দর একটি ভাস্কর্য, তারপর একুয়ারিয়ামে নানা রঙের মাছ। মাঝপথে রয়েছে দেয়ালের দু’পাশে দুটি লম্বা আয়না ওপরে উঠতে উঠতে দেখে নিতে পারবেন নিজের চেহারা। ওপরেই রয়েছে এক নজরে জেলা পরিচিতি ম্যাপ।
এবার পালা জেলা প্রশাসকের কক্ষে যাওয়ার। মিলবে টপে সংরক্ষিত নানা জাতের ফুলের চারা সদ্য ফোটা ফুলের কুড়ি অনেকেরই দৃষ্টি কাড়বে। জেলা প্রশাসকের কক্ষে ঢোকার আগেই রয়েছে একটি অভ্যর্থনা কক্ষ। যেখানে অপেক্ষমাণ জন সাধারণের জন্য রয়েছে টেলিভিশন, একটি বইয়ের তাক, যেখানে আছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহ্য-ইতিহাস নিয়ে রকমারি বই। সুন্দর টাইলস করা কক্ষে বসার জন্য রয়েছে আরামদায়ক সোফা।
জেলার সর্বোচ্চ পদের অধিকারী জেলা প্রশাসকের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে দেখা করতে আসেন নানা পেশার মানুষ। কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষাও করতে হয় তাদের। এই সময় কিভাবে কাটাবেন এমনটা যখনই ভাবছেন তখন আপনার জন্য রয়েছে দেশের সকল জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা। পত্রিকা পড়েও যদি সময় না কাটে ততক্ষণে পড়তে পারেন স্বাধীনতা বা বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি বই। প্রয়োজনে এককাপ চা ও পানির ব্যবস্থা সার্বক্ষণিক।
শহরের বেজপাড়ার বাসিন্দা মাদ্রাসা শিক্ষক মিরাজুল নানা প্রয়োজনে প্রায় দশ বছর যাবত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আসেন। তিনি বলেন, পূর্বে এত সুন্দর আর মনমুদ্ধকর পরিবেশ ছিল না এখানে। বসার জন্য ছিলো প্লাস্টিকের চেয়ার। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলে বেশ বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হতো। ভালভাবে কেউ কথাও বলতেন না। তবে বর্তমান পরিবেশ একদম পাল্টে গেছে। বসার জন্য রয়েছে বেশ উন্নতমানের সোফা।
টেলিভিশন দেখে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। এক নজরে পত্রিকাগুলোতে চোখ বুলিয়ে কখনো কখনো সেলফে থাকা বইগুলো দেখে নিয়। তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিবেশটি মন ভরে যাবার মত।
যশোর সদরের করিচিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মমিন বলেন, আমি মুক্তি যুদ্ধের ওপর বই পড়ে শেষ করেছি এই অভ্যর্থনা কক্ষে বসে। যদিও বইটি পড়ে শেষ করতে সময় লেগেছে দীর্ঘদিন। বিভিন্ন সময় প্রয়োজনে জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করতে আসি। অধিকাংশ সময় তিনি ব্যস্ত থাকেন। একদিন মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি বই দেখে তা পড়তে শুরু করি। ভেতর থেকে ডাক না আশা পর্যন্ত বই পড়ি। ভেতর থেকে ডাক আসলে যে পর্যন্ত পড়া হয়েছে তা নোট রাখি পরেরবার এসে আবার ওইখান থেকে পড়া শুরু করি এভাবেই আমি সম্পূর্ণ একটি বই পড়েছি। এর পর থেকেই বই পড়ার একটি অভ্যাস তৈরি হয়েছে। এখন সুযোগ পেলেই বই পড়ি। প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এখানে আসেন তাদের কথা চিন্তা করে জেলা প্রশাসক যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
এতো গেলো অভ্যর্থনা কক্ষের কথা। আধুনিকায়ন হয়েছে ঐতিহ্যবাহী নিয়াজ পার্কটিও যা বর্তমানে পরিচিত কালেক্টরেট পার্ক হিসাবে। নিয়াজ মোহাম্মদ খান ছিলেন যশোরের ৭৭তম ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। তার আগে মাত্র তিনজন মুসলমান যশোরে এই পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
উত্তর প্রদেশের অধিবাসী নিয়াজ মোহাম্মদ খান যশোর জেলায় শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যশোরে মিত্র বাহিনী তাদের রিজার্ভ বাহিনীর একটি বড় অংশ মজুদ রাখে। তাদের থাকার জন্য বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রিকুইজিশন করা হয়।
কিন্তু এর দরুন যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ব্যাহত না হয়, সে জন্য তিনি বিকল্প ব্যবস্থা নেন। নিয়াজ মোহাম্মদ ছিলেন বৃক্ষ প্রেমিক। তিনি বৃক্ষ রোপণে উৎসাহ দিতেন। কালেক্টরেট ভবনের উত্তর দিকের ফাঁকা স্থানে তিনি বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেন। তৈরি করেন সিমেন্টের চেয়ার। ক্রমান্বয়ে তাই এর নাম হয় নিয়াজ পার্ক। ১৯৪৮ সালে যশোরে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধে। সে সময় আন্দোলনকারীদের সভা-সমাবেশের জন্য নিয়াজ পার্ক ছিল নির্ধারিত স্থান। ১৯৪৮ সালের ১২ মার্চ এখানে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।
১৯৫২, ৬২ এবং ১৯৬৯-এর আন্দোলনের সময়ও নিয়াজ পার্ক ব্যবহৃত হয় সমাবেশের জন্য। আন্দোলনকারীরা এখানে সমাবেশ শেষে স্মারকলিপি দিতেন যশোরের জেলা প্রশাসককে। আর ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পুরো অসহযোগ আন্দোলনকালে নিয়াজ পার্কে অনুষ্ঠিত হত সমাবেশ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কুচ-কাওয়াজ।
যশোরের রাজনীতিতে দীর্ঘকাল নিয়াজ পার্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ওয়ান ইলেভেনের সময় কালেক্টরেট ভবনের সামনে ঐতিহ্যবাহী নিয়াজ পার্কটি সংস্কার করে কিছুটা নান্দনিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। একটু উদ্যোগ নিলেই যে দৃশ্যপট পাল্টে দেয়া যায় তার প্রমাণ রেখেছেন যশোরের বর্তমান জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান। চেহারা পাল্টে দিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী কালেক্টরেট ভবনের।
ঐতিহ্যবাহী ভবন নান্দনিক করবার বিষয়ে জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, প্রতিটি দেশ বা জেলার এমন একটি জায়গা থাকে যা ওই জেলার পরিচিতি বহন করে। যশোরের কালেক্টরেট ভবনের রয়েছে ২০০ বছরের ঐতিহ্য। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ্য করা যায় এই ভবনের ছবি দিয়ে যশোরকে উপস্থাপন করা হয়।
তাই আমার মনে হয়েছে ভবনটিকে কিভাবে আরও নান্দনিক করা যায়। খুব দ্রুতই এখানে দেখা মিলবে ভবনটির সাথে চমৎকার লাইটিং। ইতোমধ্যে পার্কটি নান্দনিক করা হয়েছে। ফুল দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জয়ফুল লোগো ও নাম। এখানে অবস্থিত পুকুরের সংস্কার কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে এই পুকুরে দেখা মিলবে নানা রঙের মাছ। চারপাশ সুন্দর কারে বাধানো হবে। পুকুরের মাঝে থাকবে নান্দনিক ফোয়ারা। একই সাথে শিশুদের জন্য বিশেষভাবে কিছু করা যায় কিনা সেটিও আমরা চিন্তা করছি। ইতিমধ্যে একটি বঙ্গবন্ধু কর্নার তৈরি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নান্দনিক পরিবেশের পাশাপাশি নাগরিক সেবার ব্যপারটিও লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সেবা নিতে এসে কেউ জেনো বিড়ম্বনার শিকার না হয় সেই বিষয়টিও সব সময় নজরদারি করা হয়। যেহেতু এখানে সব শ্রেণি পেশার মানুষ আসেন তাই তাদের জন্য আধুনিক অভ্যর্থনা কক্ষ তৈরি করা হয়েছে।