তৃতীয়তলা পর্যন্ত আগুন নেভাতে পারে যশোর ফায়ার সার্ভিস
বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদনের পিছে রহস্য লুকিয়ে
কর্তৃপক্ষ নিজস্ব নির্বাপণ ব্যবস্থা তাগিদ দিলেও মানা হচ্ছে না
সুনীল ঘোষ: আগুন লাগতেই পারে। যখন তখন যেখানে সেখানে আগুন লাগার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু এই দুর্ঘটনা যদি ঘটে তেল পাম্প, গ্যাস ও কেমিক্যাল ডিপো বা গুদামে তা মুহূর্তেই রূপ নেয় বিধবংসী ঘটনায়। ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষায় নির্বাপণ ও প্রতিরোধ দুটোই থাকা জরুরি। কিন্তু আদৌ কী সেই প্রস্তুতি সবখানে আছে ?
এর জবাব পাওয়া গেল যশোরে একদমই নেই। অকপটেই স্বীকার করে নেন স্টেশনটির একাধিক ফায়ার ম্যান।
যশোর ফায়ার স্টেশনে নেই কেমিক্যাল, তেল পাম্প ও গ্যাসের আগুন নেভানোর গাড়িসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। বহুতল ভবনের আগুন নেভানোর সক্ষমতাও নেই। সর্বোচ্চ তৃতীয়তলার আগুন নেভাতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। তাই বলে থেমে নেই বহুতল ভবন নির্মাণ। গত এক দশকে যশোর শহরে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। এখনো অসংখ্য ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এসব নির্মাণের অনুমোদন কিভাবে পাচ্ছেন বা দেয়া হচ্ছে তা নিয়ে রয়েছে লম্বা গল্প।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এসব বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে কিছু শর্ত সাপেক্ষে। প্রথম শর্তের মধ্যে রয়েছে অগ্নিকান্ড রুখতে নিজস্ব ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সেই নিজস্ব ব্যবস্থা আদৌ আছে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। হাতে গোনা কিছু ভবনে অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত না। এসব ভবনের তদারকি করার দায়িত্ব অনুমোদন দেয়া প্রতিষ্ঠানের। এ হিসেবে যশোরে তদারকির দায়ভার পড়ে পৌর কর্তৃপক্ষের ওপর। কিন্তু তাদের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নজরে পড়ে না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ এসব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার করতে বারবার তাগিদ দেয়। কিন্তু উপরি মহল থেকে সাড়া মেলে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যশোর ফায়ার স্টেশনের একটি সূত্র জানায়, যশোর শহরে অসংখ্য বহুতল ভবন রয়েছে অগ্নি ঝুঁকিতে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে যশোরাঞ্চলে দাহ্য পদার্থ মজুদকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে তেল পাম্প বা ডিপো এবং কেমিক্যাল কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে সবেচেয় বেশি। কারণ তেল পাম্প বা ডিপো এবং কেমিক্যাল কারখানার আগুন নেভাতে টিটিএল গাড়ি, ফোম টেন্ডার ও কেমিক্যাল টেন্ডার লাগে, যার কিছুই যশোর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে নেই।
তিনি বলেন, যশোরে দেড় হাজার কারখানা ও আড়াই হাজার গুদামের মালিক ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স নিয়েছেন। এর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা এখন পর্যন্ত লাইসেন্স নেয়নি। বার বার তাগিদ দিয়েও লাভ হচ্ছে না। যশোরাঞ্চলে দু’জন ওয়্যারিং ইন্সেপেক্টর দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বলেন, খরা মৌসুম চলছে। বিশেষ করে মাঘ-ফাল্গুন ও চৈত্রে দাবদাহ বেড়ে যায়। এ সময়ের হাওয়ার সাথে আগুনের একটা যোগ আছে। শীতে শুকিয়ে থাকা খড়কুটো ও শুকনো পাতায় আগুন লাগে সহজে। ফাল্গুনের বাতাসে সে আগুন বেগ পায় মাত্রাতিরিক্ত। চোখের নিমিষে ছাই করে দিতে পারে এ সময়ের আগুন। সূত্রের দাবি এ মৌসুমে পাটগুদাম, পানবরজ, বাজার, দোকান, শ্রমিক কলোনি, বিসিক নগরীর বিভিন্ন ক্যাটাগরি কারখানা, বস্তি, হাসপাতাল, গ্যাসপাইপ ও বাড়িঘরে আগুন লাগে। নেহায়েত তার সংখ্যা কম না। এ ধরণের আগুন সম্পদ পুড়িয়েই ছাই করে, তা নয়। অনেকেই জীবন্ত দগ্ধ হন। কেউ প্রাণ হারান, কারোর হতে হয় পঙ্গু।
খরা মৌসুমের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে মনে হলেও পরে দেখা যায় নিচেই চাপা পড়া আগুন দপ করে জ্বলে ওঠে। গার্মেন্টসের ঝুট গুদামের আগুনের সঙ্গে এই মৌসুমের আগুনের অনেকটা মিল রয়েছে। বহুতল ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ কয়েকটি বিভাগীয় শহরের ফায়ার সার্ভিস স্টেশনগুলোর প্রস্তুতি অনেক বেশি। তাদের পেশাদারত্ব অহংকার করার মতো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত যশোরে সেই প্রস্তুতি নেই।
এ বিষয়ে যশোর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মনোরঞ্জন সরকার বলেন, যশোর ফায়ার সার্ভিসের অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। ৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে দৃষ্টিকাড়া ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। রাতে টহলের গাড়ি দিয়েছে সরকার। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে এই গাড়িটি দ্রুত ছুটে যায়। হতাহতদের উদ্ধার করে নিকটবর্তী হাসপাতালে পৌঁছে দেয়।
তিনি বলেন, এখানে জনবল সংকটও নেই। তবে তেল পাম্প ও কেমিক্যাল কারখানার আগুন নেভানোর টিটিএল গাড়িসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। সর্বোচ্চ তৃতীয় তলার আগুন নেভানোর সক্ষমতা আছে। বহুতল ভবনে আগুন লাগলে তাদের তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যশোরে শর্ত সাপেক্ষে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত যশোর ফায়ার স্টেশনে একটি পানি ও একটি টানা গাড়ি রয়েছে। দুটো গাড়িই আগুন নেভানোর কাজ করে।