আবদুল কাদের
ইফতারির অন্যতম উপকরণ বিভিন্ন রকমের ফল আমদানি ও বিক্রি ঘিরে বড় সংকটে পড়েছেন যশোরের ছয় শতাধিক ফল ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক। রমজানে ফলের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও আমদানি হচ্ছে কম। ডলারের উচ্চ মানে আমদানিতে ধাক্কা, একই সাথে পাল্লা দিয়ে ফলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। চলতি মাসের প্রথম ৮দিনে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে মাত্র ১০ ট্রাক ফল আমদানি করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে রমজানের সময়ে বেনাপোল দিয়ে ট্রাক ট্রাক ফল আমদানি হলেও বর্তমান চিত্র ভিন্ন।
জেলা ফল ব্যবসায়ী সমিতি মতে, করোনার শুরু থেকে তাদের ব্যবসা মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলছে চরম ডলার সংকট। গত প্রায় এক বছর ধরে তারা ফল আমদানি করতে পারেনি। বর্তমানে কিছু ব্যবসায়ী ফল আমদানি করলেও সুবিধা করতে পারছেনা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বর্তমানে প্রতি ডলার কিনতে হচ্ছে ১১২-১১৫ টাকায়। যা আগে ছিল ৮২ টাকা। এরপরও আমদানি করার জন্য এলসি খুললে সেই পণ্য আসতে সময় লাগে প্রায় ২৫ দিন। এরমধ্যে ডলারের রেট বেড়ে যাচ্ছে।
বেনাপোল কাস্টমের যুগ্ম কমিশনার আবদুর রশিদ মিয়া বলেন, চলতি মাসের ৮ দিনে বেনাপোল দিয়ে ১০ ট্রাক বিভিন্ন ধরণের ফল আমদানি করা হয়েছে। আমরা ফল আসলেই সেটি খালাসে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।
যশোরের ফল আমদানিকারক আনসারি হোসেন সোহেল জানান, গত করোনার পর থেকে আমরা চাইলেই ফল আমদানি করতে পারছি না। এখন ডলারের সংকটের কারণে বেশিরভাগ ব্যাংক এলসি দিচ্ছে না। কিছু ব্যাংক এখন এলসি দিলেও বেশি আমদানির সুযোগ দিচ্ছে না। অল্প পরিসরে আমদানি করতে হচ্ছে। যে কারণে ডলার ১১৫ টাকায় কিনে এলসি করে দাম পড়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফল দেশে আনার পর বিক্রি করা যাচ্ছে না। কারণ খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ফলের দাম দ্বিগুন হওয়ায় বেচাবিক্রিও সেভাবে নেই।
ফলপট্টির আড়তদার মো. সেলিম জানান, তারা আমদানিকারকদের কাছ থেকে ফল ক্রয় করে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করেন। গত ২-৩ বছর ধরে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। এখন ফল ব্যবসার মৌসুম। বর্তমান সময়ে আঙুরের কেজি ২২০ টাকা, আগে ছিল ১২০ টাকা। আর কালো আঙুর খুচরা পর্যায়ে ৫শ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আগে ছিল ২৫০ টাকা কেজি। কমলা লেবু বিক্রি হচ্ছে ২শ টাকায়, আগে ছিল ১২০ টাকা। আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা, আগে ছিল দেড়শ টাকা, মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা, আগে ছিল দেড়শ টাকা। বেদানা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা কেজি, আগে ছিল আড়াইশ টাকা। বস্তা খেজুর প্রতি কেজি দেড়শ ও মরিয়ম মানভেদে ৮০০ থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এভাবে সব ফলে দাম বেশি। এতে ক্রেতারা সেভাবে কিনছে না। যা বিক্রি হচ্ছে তাতে টিকে থাকা চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে।র্
আরও পড়ুন:যশোরে গবেষণা-সম্প্রসারণ কৃষক সন্নিবদ্ধ কর্মশালা অনুষ্ঠিত
শহরের চৌরাস্তার খুচরা ফল ব্যবসায়ী শাহাজাদা হোসেন বলেন, আগে ফল বিক্রি করে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাভ হতো। কিন্তু গত দু’বছর ধরে ব্যবসা নেই। যা হচ্ছে তাতে কোন রকম টিকে রয়েছি। তিনি বলেন, ফল সাধারণত স্বচ্ছলরা কিনে থাকেন। মধ্যবিত্তরা এখন ফল কিনতে পারছে না। সরকারি কর্মকর্তরাই এখন আমাদের ক্রেতা।
যশোর জেলা ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম লিটন বলেন, যশোরে ৬ শতাধিক ফল ব্যবসায়ী রয়েছে। এরমধ্যে আড়তদার রয়েছেন ২শ। আমদানিকারক আছেন কমপক্ষে ২০ জন। এই পেশার সাথে কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ জড়িয়ে রয়েছেন। স্বাভাবিক সময়ে এখানে বছরে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। গত এক বছর ধরে আমদানিককারকরা ডলার সংকটে ফল আমদানি করতে পারছে না। কিছু দিন হলো রমজানকে সামনে রেখে খেজুর ও অন্যান্য ফল আনছেন। কিন্তু দাম পড়ছে চড়া। আগে এক ক্যারেট আঙ্গুর আনতে সরকারকে রাজস্ব দিতে হতো ১২শ টাকা, সেখানে এখন দিতে হচ্ছে ১৮শ টাকা। বেদানা আগে ৮শ টাকার জায়গায় এখন ২ হাজার টাকা, লেবু ৭শ টাকার জায়গায় ১৮ হাজার এবং আপেল ৬শ টাকার জায়গায় ১২শ টাকা, মরিয়ম খেজুর (৫ কেজি) আগে ২২শ টাকা দিতে হলেও এখন দিতে হচ্ছে ৩৫শ টাকা শুল্ক। সব ফলের দাম বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা ফল কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন ফল কিনছেন শুধুমাত্র উচ্চবিত্তরা। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, আসছে রমজানে ফলের বাজার থাকবে চড়া। একই সরকার শুল্কছাড় দিলে তবেই ক্রেতারা নাগালের মধ্যে দাম পাবেন।
যশোর জেলা ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন চুন্নু বলেন, ডলারের অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সব ফল ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একটি এলসি খুললে সেই পণ্য ভারত থেকে আসতে ২৫ দিন সময় লেগে যায়। তখন দেখা যাচ্ছে ডলারের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীকে সেই বেশি দাম ব্যাংকে পরিশোধ করতে হয়। আবার শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় ফলের দাম অনেক বেড়েছে। এতে আমরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। দাম বৃদ্ধির ফলে ক্রেতারা কিনছেন কম।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, এলসি করতে না পেরে আমদানিকারকরা সবাই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। আসছে রমজানে ফল বেশি আমদানি না হলে ক্রেতারা সুফল পাবেনা। সবাই বেশি দামে ফল কিনবেনা। বাজার সহনীয় রাখতে সরকারকে ফল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিতে হবে।
আরও পড়ুন: যশোরে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট আদ-দ্বীন সকিনা হাসপাতাল উদ্বোধন