নিজস্ব প্রতিবেদক: কইতো যাহা আমার দাদায়/কইছে তাহা আমার বাবায়/এখন, কও দেখি মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়/সইমু না আর সইমু না/অন্য কথা কইমু না …। বাপ-দাদার সেই মুখের বুলি ছেড়ে অন্য ভাষায় কথা বলতে চায়নি বাংলার দ্রোহী সন্তানেরা। তাই তো রক্তঋণে অর্জিত হয়েছিল পিতৃপুরুষের ভাষার অধিকার।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করেছিল তারা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রক্ষা করেছিল মায়ের ভাষা বাংলাকে।
মূলত তিনটি পক্ষ ১৪৪ ধারার ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গী করে যুবলীগ নেতাকর্মীসহ কয়েক সাহসী ছাত্রনেতা অগ্রাহ্য করেছিল দলীয় সিদ্ধান্তকে। আন্দোলনের রাশ টেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও গুপ্ত কমিউনিট পার্টির গৃহীত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের আকাক্সক্ষা ভেস্তে গিয়েছিল। সেই সুবাদে বায়ান্নর ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারির গভীররাতে ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) মধ্যবর্তী পুকুরপাড়ে নির্মিত হয়েছিল নতুন ইতিহাস। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, যে কোন মূল্যেই হোক ভাঙা হবে ১৪৪ ধারা। সেজন্য কিছু কৌশল অবলম্বনের সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছিল। যেহেতু আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করলে ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরুদ্ধে মত দিতে পারেন তাই গাজীউল হককেই আমতলার সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত হয়। তিনি যদি সভার আগেই গ্রেফতার হন সেক্ষেত্রে এম আর আখতার মুকুল সভাপতিত্ব করবেন। আবার তিনি গ্রেফতার হলে সভাপতিত্ব করবেন কমরুদ্দিন শহুদ।
বশীর আলহেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে উঠে এসেছে সেদিনের ঘটনার প্রকৃত চিত্র। সেখানে পুকুরপাড়ের ওই বৈঠকের বর্ণনায় মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, ‘২০ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যাটা আমার কাছে খুব থমথমে মনে হয়েছিল। কি রকম একটা বিপদ-সংকেতের মতো শোনাচ্ছিল সরকারী গাড়ি থেকে ১৪৪ ধারা জারির সংবাদ-পরিবেশনটি। যখন শুনলাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই। … রাত নটা দশটার সময় আমরা সাত আট বন্ধুবান্ধব মিলিত হই ফজলুল হক হলের পূর্ব পাড়ে। যতদূর মনে পড়ে সেখানে মুহম্মদ সুলতান, আবদুল মমিন, জিল্লুর রহমান, কামরুদ্দিন শহুদ, গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান ও এম আর আখতার উপস্থিত ছিলেন। অনেক পরে শুনেছি যে, ওই বৈঠকে একজন গুপ্তচরও উপস্থিত ছিলেন। আমি এখন তার চেহারা মনে করতে পারছি না।’
অন্যদিকে গাজীউল হক বলেছেন এ বৈঠকে ১১ জন উপস্থিত ছিলেন। তিনি এছাড়া অন্য যেসব নাম বলেছেন সেগুলো হলো এসএ বারী, এটি মশিয়ুর রহমান, আনোয়ার হোসেন। তিনিও একজনের নাম মনে করতে পারেননি। আর তিনি জানিয়েছেন এ বৈঠক রাত প্রায় বারোটার দিকে হয়েছিল।
এম আর আখতার মুকুল অসতর্কভাবে দুটি নাম বলেছেন আহমদ রফিক ও অলি আহাদ। তবে অলি আহাদ জানিয়েছেন তিনি সেখানে ছিলেন না। মোহাম্মদ সুলতানও ১১ জনের কথা বলেছেন এবং অন্যের তালিকায় নেই এমন একটা নাম বলেছেন তিনি কে জি মোস্তফা।
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না- সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সভা শেষে বেরিয়ে আসেন অলি আহাদ। এ সময় তার সঙ্গে দেখা হয় জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ও যুবলীগ কর্মী নেয়ামাল বাসির ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে। অলি আহাদ তাদের সুশৃঙ্খলভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা বিভাগ প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ার নির্দেশ দিলেন। সেদিন গভীররাতে যুবলীগের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক ও অনাবাসিক কর্মী ৪৩/১ যোগীনগরে যুবলীগ কার্যালয়ে অলি আহাদের সঙ্গে দেখা করেন। ঢাকার নানা এলাকার যুবলীগ কর্মীরাও এসেছিলেন নির্দেশ জানতে।
প্রকৃতপক্ষে ১৪৪ ধারা জারির মাধ্যমে ছাত্রদের দ্রোহী চৈতন্যে চরমভাবে আঘাত করেছিল তৎকালীন সরকার। তাদের সেই অপমানের জ্বালা তীব্র খরতাপ ছড়িয়েছিল বসন্তের বাতাসে। তাই পলাশের রং মাখা ফাগুনে ভাষার দাবিতে উত্তপ্ত হৃদয়ের বহ্নিশিখায় প্রজ্বলিত হয়ে সবাই নেমেছিল রাজপথে।