নিজস্ব প্রতিবেদক: বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ইতিহাস। শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ওই বছরের ১৫ মার্চ ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্ররা সংগ্রাম পরিষদ আহূত ধর্মঘটে পিকেটিং শুরু করে। ভাষার দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলনে পুলিশের যে ধরপাকড় নির্যাতন চলছিল তার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে এই ধর্মঘট চলছিল। ঢাকার মেডিক্যাল কলেজের সামনে ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলনে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হলেও অব্যাহত থাকে বিক্ষোভ। ছাত্র জনতা পরিষদ ভবনের সামনে চলে সংগ্রামী কর্মসূচী। এদিন মোহাম্মদ তোয়াহা ও তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্রদের সংগঠিত করেছিলেন।
এর আগেই ১১ মার্চ আহূত ধর্মঘট সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জ, গণগ্রেফতার আগুনে ঘি ঢালার মতো ছাত্রদের রাস্তায় টেনে আনে। শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না এ আন্দোলন। পূর্ব বাংলার সবকটি জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল এ আন্দোলন। ১১ মার্চের আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন ২০০ জন। গ্রেফতার হয়েছিল ৯০০ জন । পরে অনেককে ছেড়ে দেয়া হলেও জেলবন্দী ছিল ৬৯ জন।
১৫ মার্চ ছিল পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের প্রথম অধিবেশন। আগেরদিন ১৪ মার্চ রাতে খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য ডাক্তার মালিক, তোফাজ্জল আলী ও এম এ সবুরকে এক চিঠি দিয়ে পাঠান কামরুদ্দিন আহমদের কাছে। চিঠিতে তিনি বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে চান। উত্তরে কামরুদ্দিন বলেন, যেহেতু আবুল কাসেম ও তিনি ছাড়া আর সবাই জেলে সেহেতু কোন আলাপ চলতে পারে না। পরদিন খাজা নাজিমুদ্দিন জানান তিনি আলোচনা করতে রাজি আছেন এবং তাদের নির্দেশ মানতে রাজি আছেন। এরপর ছাত্ররা নিজেদের সঙ্গে আলোচনার পর সেদিন খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে বর্ধমান হাউসে আলোচনা শুরু করে। সে আলোচনায় তুমুল উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পরিষদের সদস্যদের অনমনীয়তায় সবকটি শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু চুক্তি তখনই স্বাক্ষরিত হয় না। জেলে গিয়ে আবুল কাসেম ও কামরুদ্দিন আহমদ জেলে বন্দী পরিষদ সদস্যদের চুক্তিগুলো দেখান। এ সময় জেলে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক প্রমুখ এ চুক্তির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তখন সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা বর্ধমান হাউসে ফিরে এলে সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দীন আহমদ চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল- সকল রাজবন্দীদের মুক্তি, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সেদিনের অধিবেশনেই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তারে সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করা হবে বলে প্রস্তাব গ্রহণ এবং সেদিনই ব্যবস্থা পরিষদ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কেন্দ্রের নিকট অনুমোদনসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করবে। ১৭ই মার্চ আজাদ পত্রিকার প্রথম শিরোনাম ছিল ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকৃত ঃ চার দিনব্যাপী আন্দোলনের ফলে ভাষা সঙ্কটের সমাধান’।
কিন্তু সেদিনের সেই চুক্তি যে একটি ভাওতা ছিল তা বুঝতে দেরি হয়নি। কেননা সেদিন অধিবেশনে চুক্তির কোন কথাই পালন করা হয়নি। ফলে ছাত্ররা অধিবেশনের শেষে তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় পুলিশের লাঠিচার্জে অসংখ্য ছাত্র আহত হন। পরদিনও প্রচ- বিক্ষোভ চলতে থাকে। ১৬ মার্চ সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদ স্বরূপ ১৭ মার্চ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে ও ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। খাজা নাজিমুদ্দিন ভেবেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এলে পরিস্থিতি শান্ত হবে। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আগমন ও বক্তৃতা পূর্ব বাংলার মানুষদের মনে পরিষ্কার ধারণা দিয়ে যায় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে সরকার কোন রকম ইতিবাচক চিন্তাই করছে না।