জহিরুল জিতু: যশোর সদর উপজেলার মুড়লি এলাকা হতে পারে হেরিটেজ ট্যুরিস্ট স্পট। ভৈরব নদীর তীর ঘেষে গড়ে ওঠা মুড়লির রয়েছে বহু প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এখানে প্রাচীন ঐতিহ্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে মুড়লীতে হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের নির্মিত ইমামবাড়া, হাজী মুহাম্মদ মহসীন স্কুলে আখড়াপাড়া মন্দির, বকচর মোড়ে চৌধুরী বাড়ি শিব মন্দির, লক্ষী নারায়ণ মন্দির, জোড়া শিব মন্দির প্রভৃতি। তাছাড়া মুড়লির কাছেই রয়েছে রামনগরের ক্ষণিকা পিকনিক কর্নার, চাঁচড়া এলাকায় চাঁচড়া রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, প্রাচীন কালীমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, জোড় বাংলো মন্দির প্রভৃতি।
রামনগর ইউনিয়নের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রাম মুড়লী। রামনগর নাম থেকে বোঝা যায়, একসময় এটি একটি বড় নগর ছিল। আর মুড়লি ছিল কসবা। কসবা ফারসি শব্দ। কসবার অর্থ হল নগর। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ মনে করেন, প্রাচীনকালে ভৈরব নদের তীরবর্তী মুড়লী কসবায় বৌদ্ধ সংঘরাম ছিল। সুলতানী আমল পর্যন্ত যশোর মুড়লী কসবা নামে পরিচিত ছিল। ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র তার ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে মুড়লী কসবা সম্মন্ধে বলেন, ‘মুড়লী অতি প্রাচীন স্থান। এমন কোন প্রাচীন ম্যাপ বা ভৌগলিক বৃত্তান্ত নাই, যাহাতে মুড়লীর নাম নাই। মুড়লীতে বৌদ্ধ স্তুপ ছিল বলে মনে হয়’।
আখড়াপাড়া মন্দির
এই মুড়লীতে ১৯ শতকের শেষের দিকে আখড়াপাড়া মন্দিরটি নির্মিত হয়। মুড়লী বাস স্টপেজের প্রায় ৩০০ ফুট উত্তর পশ্চিমে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন স্কুলের পূর্ব পাশে এটি অবস্থিত। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, এটি নিয়ে যশোর হিন্দু পরিষদের সাথে মামলা মকদ্দমা চলছে ১৯৮৮ সাল থেকে। এটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। মাটি থেকে ভিত ৪ ফুট উঁচু মন্দিরটিতে পাঁচটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। এর সামনের বারান্দার পলেস্তারা খসে পড়ে গেছে। ছাদ সমতল এবং কার্নিশ একটু বাঁকানো। সেখানে জ্যামিতিক, তারা আকৃতির ও ফুলের স্টাকো নকশা রয়েছে। পশ্চিম কোনার দরজাটিতে সিঁড়ি ছিল।
জোড়া শিব মন্দির
মুড়লীতে যশোর-খুলনা মহাসড়কের উত্তরে (প্রায় ৩০ হাত দূরে) জোড়া শিবমন্দির অবস্থিত। পাশাপাশি দুটি একই ধরনের নকশার শিব মন্দির। এটির পূর্ব দিকে একটি পুকুর আছে। সামনে বড় উঠান রয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে একটি স্কুল ও সবুজ সংঘ ক্লাব রয়েছে। সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য মন্দির কমিটি বহু কাজ করেছে এবং সবসময় দেখভাল করছে। মন্দিরটিতে চৌচালা আকৃতির ছাদ, নিচে অবশ্য গোলাকার গম্বুজ রয়েছে। আর শীর্ষ চূড়া ছোট চৌচালা এবং তার মাথায় লোহার দন্ড রয়েছে। প্রবেশ পথের ওপরে স্টাকো করে লেখা রয়েছে শকাব্দা ১৭০৪ আর সন ১১৮৯। সন টিকে বাংলা সাল ধরা হলে ইংরেজি ১৭৮৪ হয়। এটিকে নির্মাণ কাল বলা ধরা যায়।
লক্ষী নারায়ণ মন্দির
লক্ষী নারায়ণ দেব বিগ্রহ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। লক্ষ¥ী নারায়ণ মন্দিরটি বকচরের চৌধুরী বাড়ি মোড়ে অবস্থিত। তারিনী চরণ চৌধুরী ও তার স্ত্রী গোপী সুন্দরী চৌধুরী এটি নির্মাণ করেন। সমতল ছাদের এই মন্দিরটিতে ৩ টি কক্ষ রয়েছে। ১ টি কক্ষ শিবের, ১ টি অন্যান্য দেবদেবীর এবং বাকিটি পুরোহিতের থাকার জন্য। এখানে কষ্টি পাথরের ১ টি শিবলিঙ্গ রয়েছে। প্রবেশের জন্য পাঁচটি দরজা রয়েছে। দরজাগুলি কাঠের কারুকার্য সম্বলিত এবং খিলান সহযোগে নির্মিত। খিলানের টিমপ্যানামে কাঠের অলংকরণযুক্ত। এখানে প্রতিনিয়ত পূজা হয়।
চৌধুরী বাড়ি শিবমন্দির
খুলনা বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে বকচর এলাকায় চৌধুরী বাড়ি শিবমন্দির অবস্থিত। উত্তর-দক্ষিণ মুখী মন্দিরটি পুরোটায় ঢাকা পড়েছে মার্কেটের কারণে। পশ্চিম দিকে একটা খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। আর চূড়ার ওপর বটগাছ জন্ম নিয়েছে। মূল প্রবেশপথ ছিল দক্ষিণ দিকে (যা বর্তমানে ইটের গাঁথনি দিয়ে বন্ধ করা)। এটি একেবারে পরিত্যক্ত। দিনের বেলায়ও ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছাদের ওপরে ছোট শিখর রয়েছে যা বর্তমানেও অনেক সৌন্দর্যমন্ডিত। ছোট ছোট স্তম্ভ সহযোগে বদ্ধ খিলান ডিজাইন করা, আবার বর্ডার করে সেখানে পলেস্তরার ওপর চিকন দাঁত নকশা করা হয়েছে এবং ওপরে বারবার অর্ধবৃত্তের লাইন কেটে ডিজাইন করা হয়েছে। মাথায় একটি লোহার দন্ডও রয়েছে।
হাজী মুহাম্মদ মুহসীন ইমামবাড়া
হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের ইমামবাড়া (শিয়াদের মুহররম অনষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত ঘরকে ইমামবাড়া বলা হয়) মুড়লী বাস স্টপেজের জোড়া শিব মন্দিরের কাছে অবস্থিত। এই ইমারতটি আয়তাকার। এটি উত্তর দক্ষিণে ৬০ ফুট এবং পূর্ব পশ্চিমে ৫০ ফুট। ভেতরের অংশ ১০টি পিলার দিয়ে ৩ সারিতে বিভক্ত। খিলানগুলো কিছুটা খাঁজকাটা এবং নকশাযুক্ত। সাধারণ পলেস্তারার ওপর ফুলের নকশা রয়েছে। ছাদ সমতল। ছাদের সিলিং-এ ফুলের স্টাকো নকশা রয়েছে। সামনে চারধাপে সিড়ি রয়েছে।
আঠারো শতকের প্রথমদিকে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন এ ইমারতটি নির্মাণ করেন। এটি শিয়া মতাবলম্বীদের পবিত্র পাদপীঠ। এর দক্ষিণ পাশে একটি ছোট পুকুর রয়েছে। বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে। চারদিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং নতুন নির্মিত গেট রয়েছে। দক্ষিণ দিকের তিনটি দরজা বন্ধ করে দিয়েছে ইটের গাথনি দিয়ে। এটি একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি এবং সেখানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সাইনবোর্ড টানানো রয়েছে। একইভাবে পুরো এলাকাকে সংরক্ষণের আওতায় এনে একটি হেরিটেজ ট্যুরিস্ট স্পট ঘোষণা করা হলে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো যেমন আমাদের কালের সাক্ষি হয়ে টিকে থাকবে।