নিজস্ব প্রতিবেদক, মণিরামপুর
রাতের আঁধার থাকতে থাকতে সরঞ্জাম নিয়ে দলে দলে শ্রমিকরা জড়ো হচ্ছেন। একই সাথে আসছেন গেরস্ত কৃষক। পাশাপাশি অন্য চাষিদেরও সমাগম কম নয়। শ্রমিকরা এসেছেন নিজেকে বিক্রি করতে। আর অন্যরা এসেছেন তাদের শ্রম কিনতে। সবমিলিয়ে জমে উঠেছে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টার শ্রমিক কেনাবেচার হাট।
বলছিলাম যশোর জেলার পুলেরহাট-রাজগঞ্জ সড়কের মণিরামপুর উপজেলার হানুয়ার বটতলা মোড়ের শ্রমিকের হাট কথা। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘জন বেচার হাট’ নামে পরিচিত। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যায় ‘জন বেচার’ এ হাট।
স্থানীয়রা জানান, বিশেষ করে বোরো ধান কাটার মৌসুম আসলে নিয়মিত খুব সকালে এখানে শত শত শ্রমিকের ভিড় জমে। উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি অন্য উপজেলা থেকে ধান চাষিরা ভোর থেকে এখানে জড়ো হন শ্রমিক কিনতে। শুরু হয় দু’পক্ষের দর কষাকষি। হিসেব মিললে এরপর ক্ষেত মালিকরা ভ্যান, ইজিবাইক বা মোটরসাইকেলে তুলে শ্রমিক নিয়ে রওয়ানা হন মাঠে। এভাবে নিত্য ভোরে মানুষের কোলাহলে জমে ওঠে হানুয়ার বটতলার। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে এ হাটের বয়স শত বছর পেরিয়েছে। আমন ধান কাটার সময়ও কিছু শ্রমিক বাইরে থেকে এখানে আসেন। তবে বোরো মৌসুমে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কেননা বৃষ্টির আশঙ্কায় কৃষক তাড়াতাড়ি ঘরে ধান তুলতে যান।
এবার শ্রমিক কেনাবেচার হাটে এবার শ্রমিকের দর খুব চড়া। এবার ধান কাটার মৌসুমের শুরুতে ৬৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় শ্রমিক বিক্রি হয়েছে। কিন্তু চাহিদা বেশি হওয়ায় এক হাজারের নিচে কোনো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। যে শ্রমিক বেশি পারদর্শী তাকে ১৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। গেল বোরো মৌসুমে শ্রমিকের দর ছিল সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা।
ধান চাষিরা বলছেন, এখানকার শ্রমিকরা বেশ সৌখিন। বেলা ১০টার পর আর কেউ কাজ করতে চান না। কাজ শেষে মালিকের বাড়ি গরম ভাত খেয়ে মজুরি নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়েন। অনেক শ্রমিক আবার ডাল তরকারি খেতে চাননা। এজন্য কাজে আসার আগে তারা মালিকের সাথে মাংস-ভাতের কথা পাকা করে নেন।
ঝাঁপা গ্রামে ধান চাষি শাহিনুর রহমান বলেন, ‘তিন বিঘা জমির ধান কাটতে ঈদের আগে হানুয়ার মোড় থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা করে ছয় জন শ্রমিক কিনেছি। এলাকার লোক দিয়ে ১ হাজার ১০০ টাকা মজুরিতে সে ধান বাঁধার কাজ করিয়েছি। পরে ধান বাড়ি নিতে এলাকায় শ্রমিক না পেয়ে গত রোববার ভোরে আবার হানুয়ার মোড়ে গিছি। সেখানে শ্রমিকের চেয়ে ক্ষেত মালিক বেশি। পরে ১৫০০ টাকা করে আট জন শ্রমিক কিনেছি। সকাল সাড়ে ৬ টায় কাজে যোগ দিয়ে বেলা ১০ টায় সবাই কাজ ছেড়ে দেছে। এরপর মাংস-ভাত খেয়ে টাকা নিয়ে তারা চলে গেছে।
বিল্লাল হোসেন নামে এক শ্রমিক বলেন, কেশবপুর মূলগ্রাম থেকে তিন জন এসেছি। ১২ কাঠা জমির ধান টানার কাজ দু’হাজার টাকায় নিছি। দিঘিরপাড় গ্রামের চাষি রুবেল হোসেন বলেন, এক বিঘা ধান কাটার জন্য দুজন শ্রমিক নিছি। ১৪০০ টাকা দিতে হবে।
উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামের আবু মুসা বলেন, ‘দুদিন আগে এক হাজার টাকায় জন কিনে ধান কাটাইছি। আর বান্ধার জন্যি লোক কিনতে আইছি। দামে না পটায় লোক নিতে পারিনি।’
হানুয়ার বটতলা মোড়ের সাইকেল গ্যারেজের প্রবীণ মিস্ত্রি আব্দুল মমিন বলেন, ‘ছোট্টকাল থেকে দেখছি এ মোড়ে জন কেনার হাট বসে। ধান কাটার সিজন (মৌসুম) আসলি আশপাশের ১৫-২০ গ্রামের লোকজন কাজের জন্যি এখানে এসে ভিড় করে। ফজরের আজান দিলে লোক আসা শুরু হয়। এরপর আশপাশের ক্ষেত মালিকরা এমনকি ৫-৭ মাইল দূর থেকে লোক এসে এদের কিনে নেয়।