সামসুল করিম ইমন, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ): ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ফেরিওয়ালা মিরাজুল হকের স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার আজ আলোর মুখ দেখতে চলেছে। পাঠাগারটি নির্মাণে দীর্ঘ বছর ধরেই মিরাজুল হক সরকারের বিভিন্ন দফতর ও জনপ্রতিনিধিসহ মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সমাজের কিছু দানশীল ব্যক্তিদের অর্থিক সহযোগিতায় আজ পাঠাগারটির নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্নের পথে। তবে বাকি কাজটুকু সম্পন্ন করতে তিনি কালীগঞ্জের সর্Ÿশ্রেণির মানুষের সহযোগিতার আহবান জানিয়েছেন।
কালীগঞ্জ শহরের কলেজপাড়ার এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান মিরাজুল হক। পিতার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। সংসারের অভাবের তাড়নায় মাত্র ১২ বছর বয়সেই তাকে রাস্তায় নামতে হয়েছে। বেছে নিয়েছিলেন হকারী পেশা। শহরের মেইন বাসস্ট্যান্ডে বাসে গণপরিবহনে বিক্রি করতেন তিলের খাজা, ঝুরি ভাজা, শসা, পেয়ারা। কখনো আবার হাতপাখা ও রুমাল ছাড়াও বিভিন্ন জিনিসপত্র ফেরি করে বেড়াতেন। এ জন্য কালীগঞ্জ শহরের সবাই তাকে এক নামে ফেরিওয়ালা মিরাজুল হক বলেই চিনেন। এখনো তার হকারী পেশাটি চালিয়ে যাচ্ছেন।
দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক মিরাজুল একজন গর্বিত পিতা। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টারস শেষ করে ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার্থী। এখন চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন। আর ছোট ছেলে আলমগীর হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বর্তমানে ঢাকা মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের একজন কৃতি ফুটবলার। আর হকারি করেই মেয়েকেও একটি ভাল সংসারে বিয়ে দিয়েছেন।
মিরাজুল হক জানান, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়ায় অর্থাভাবে সামান্য পড়াশুনা করেই ছিটকে পড়েছিল। সেই কষ্ট থেকেই তার বই পড়ার নেশা জন্মে। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই তিনি বই পড়েন। তার স্বপ্ন অর্থাভাবে শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়া মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি গণপাঠাগার স্থাপন। সেই স্বপ্ন থেকেই ১৯৯৮ সালে একটি পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তখন রাজনৈতিক নানা জটিলতায় পড়ে তার সে উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। তবে হাল ছাড়েননি। নিজে হকারির উপার্জিত অর্থ দিয়েই এ পর্ষন্ত প্রায় ৩ লাখ টাকার বই কিনেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনী, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মগ্রন্থসহ বিভিন্ন গল্পের প্রায় চার শতাধিক বই তার সংগ্রহে রয়েছে। শুরু থেকে অনেকবার পাঠাগার নির্মাণ করতে ব্যর্থ হবার পর ২০১৪ সালে কিছু বঙ্গবন্ধু অনুসারীদের নিয়ে কলেজপাড়ায় স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার। সেখানেও পদ পদবী এবং স্বার্থের বেড়াজালে শুরু হয় রাজনৈতিক জটিলতা। এরপর ৩ বছর জায়গার অভাবে তার ক্রয়কৃত সবগুলো বই পলিথিনে মুড়িয়ে নিজের ঝুপড়ি ঘরে রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ বছর অপেক্ষা করেও হাল ছাড়েননি মিরাজুল। স্থানীয় মিডিয়া কর্মীদের সহযোগিতায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় মিরাজুলের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারের কাহিনী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আইডির মাধ্যমে তিনি তার স্বপ্নের পাঠাগারটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য সর্বসাধারণের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। এতে কিছু শিক্ষানুরাগী, সাংবাদিক, সুধীমহল ও দানশীল ব্যক্তিসহ জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে আসেন। তাদের আর্থিক সহযোগিতায় মিরাজুলের উদ্যোগে জায়গা নির্ধারণ করে গত বছর ১ নভেম্বর থেকে শহরের কলেজ রোডে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারের নির্মাণ কাজ। পাঠাগারটির ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ।
মিরাজুল আরও জানান, প্রয়োজন মতো সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে নির্মাণ কাজ চলছে ধীর গতিতে। টাকার অভাবে মাঝে মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে নির্মাণ কাজ। এখনো পাঠাগারটির পুরোপুরি দৃশ্যমান করতে প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা প্রয়োজন। তিনি তার স্বপ্নের পাঠাগারটির কাজ সমাপ্ত করতে সর্ব শ্রেণি পেশার মানুষের প্রতি আর্থিক সহযোগিতা কামনা করেছেন।