রায়হান সিদ্দিক: যশোরের মণিরামপুর উপজেলার সম্বলডাঙ্গা ডুমুরবিলে অবস্থিত শাহমান্দারতলা। এখানে অবস্থিত বটগাছে সুতো ঝুলিয়ে প্রতিদিন মানত করতে আসেন শত শত মানুষ। বিলের গাঁ ঘেষে চার ধারে কাটাখালি, ভোমরদহ, নলডাঙ্গা, হাজিরহাটসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম। তারই মাঝে একসময় ছিল ঘন বনজঙ্গল।
নির্জন জঙ্গলে বাস করতো বাঘ, ভাল্লুক, শুকরসহ নানা ধরণের হিংস্র প্রাণি। ভয়ে সেখানে কেউ যেতে সাহস পেতো না। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে জনৈক ব্যক্তি আসেন এখানে। কয়েক বছর অবস্থান করার পর তার পরিচয় মেলে তিনি পীর শাহ মান্দার। কয়েক বছর জঙ্গলের মাঝে একটা বটগাছের নীচে একা একা থাকতেন। তারপর থেকে সেখানে দু’একজন মানুষের আসা যাওয়া শুরু হয়। তবে সন্ধ্যার পর সেখানে কেউ যেতে সাহস পেতনা। এরপর তিনি কবে, কখন কোথায় চলে যান তা কেউ জানে না। তারপর থেকে জায়গাটির নামকরণ হয় শাহমান্দার তলা।
শাহমান্দারতলা একটি পবিত্রস্থান। সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে হিন্দু-মুসলমান সবাই একই স্থানে যে যার ধর্ম কর্ম করছেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ বলেন পীরস্থান, আর হিন্দুরা বলেন পূজাস্থান। এ ব্যাপারে যে যাই বলুক না কেন এতে কারও কোন আপত্তি বা বাঁধা-বিপত্তি নেই।
কোন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে এবাদত বা উপাসনা করার উদ্দেশ্যে আসেন না। আসেন এক বুক আশা নিয়ে। হিন্দু-মুসলিমসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ যার সন্তান হয়নি সে সন্তান লাভের আশায়, কেউবা বালা-মুছিবত, বিপদ-আপদ, হামলা-মামলা থেকে মুক্তির আশায় আসেন। শাহমান্দার তলায় একটি নিম ও একটি বটগাছ আছে। সে গাছ তলায় নারী-পুরুষ কাপড়ের আঁচল বিছিয়ে বসেন। ফুল-পাতা পড়লে সেটা আশা পূরণের প্রত্যাশায় বটগাছে ইট ঝুলিয়ে মানত করে ফুল-পাতা ব্যবহার করেন। সুফল পেলে গরু-ছাগল.হাস-মুরগি, টাকা-পয়সা দিয়ে মানত শোধ করেন। গোসাই গণেশ দাস প্রায় ৩০ বছর ধরে এটির দেখাশুনা করেন। ভক্তবৃন্দ যা দেন তাই খেয়ে জীবন ধারণ করেন তিনি।
উপজেলার কাটাখালি গ্রামের সন্তোষ কুমার মন্ডল (৮৪), পশুপতি মন্ডলসহ (৭৩) কয়েকজন জানান, তাদের দাদার মুখে শুনেছেন, শাহ-মান্দার নামের এক পীর এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন মাঠের মাঝে এ মান্দারতলা গভীর জঙ্গলে ভরা ছিল। বাঘ, ভাল্লুক, শেয়ালসহ বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণী থাকতো। লোকজন সেখানে যেতে সাহস পেতেন না। তারই মাঝে শাহ-মান্দার পীর কয়েক বছর অবস্থান করেন। এর আগে কাটাখালি কুড় নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান দেখাশুনা করার দায়িত্বে থাকা গোসাই গণেশ দাস জানান, তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর যাবৎ শাহ মান্দার তলা দেখাশুনা করেন। এর আগে কার্ত্তিক চন্দ্র গোসাই দেখাশুনা করতেন। এ দু’জন গোসাই দীর্ঘ ৬০ বছর দেখাশুনা করে আসছেন। তবে তার আগে কেউ দেখাশুনা করেছেন কি না সে কথা কেউ জানেন না। তিনি আরও জানান, সে সময় হয়তো কেউ দেখাশুনা করার দায়িত্বে ছিলেন না। উন্মুক্ত জায়গা ছিল। স্থানীয় লোকজন জানান, শাহ মান্দার তলা জায়গাকে কেন্দ্র করে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। যা আজও এলাকার মানুষের মুখে-মুখে কিংবদন্তি কাহিনীর মত ভেসে বেড়াচ্ছে।
শর্মীলা দাস, লিপিকা দাসসহ কয়েকজন বলেন, আমাদের পরিবারের লোকজন ৩৫-৪০ বছর যাবৎ শাহ মান্দার তলায় বিপদ-আপদ, বালা-মুছিবতের জন্য আসে। মুক্তি পায় এবং মানত দেয়। বিলের ধারে যে বনে বন্য হিংস্র প্রাণীর বসবাস ছিল। কালের আবর্তে সেই জঙ্গলে গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন আসেন শত শত মানুষ। তবে সপ্তাহের বৃহস্পতি ও রোববার বেশি মানুষের সমাগম ঘটে।