কল্যাণ ডেস্ক: দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতির চাপে অনেকেই এখন ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ব্যয় ঠিক রাখতে গিয়ে প্রতি মাসেই ধারদেনা করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থা চলতে থকলে অপুষ্টির শিকার হতে পারে দেশের বড় একটি অংশ। বাড়তে পারে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা।
বাজারে এখন শুধু ভোজ্য তেলের দামই নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই বাড়ছে। দামবৃদ্ধির এই চাপ টের পাচ্ছেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা।
এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, তাদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। কেউ সঞ্চয় ভেঙে খরচ চালাচ্ছেন। আর দাম বাড়ায় অনেকেই পছন্দের খাবারে এনেছেন পরিবর্তন। যেমন গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। কেউবা আগের চেয়ে প্রয়োজনের তুলনায় কম খেয়ে চাপ সামলাচ্ছেন।
এমনই একজন হলেন জেসমিন আক্তার। তিনি ঢাকার একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক। বেতন পান ২৭ হাজার টাকা। তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বেতন পান ৫০ হাজার টাকা। গত তিন বছরে তার স্বামীর বেতন বাড়েনি। তার বেতন এক বছরে বেড়েছে মাত্র ৭০০ টাকা। তাদের একটি সন্তান আছে। স্বামী স্ত্রী দুজনকেই নিজ নিজ বাবা-মা ও ভাই-বোনদের খরচ চালাতে হয়।
জেসমিন আক্তার জানান, ‘‘গত এক বছরে আমাদের পরিবারের খরচ প্রায় দুইগুণ বেড়ে গেছে। শুধু তেলের দাম নয়, শাকসবজিসহ সবকিছুর দামই বেড়ে গেছে। আগে যা ১০০ টাকায় কিনতাম তা কিনতে এখন ২০০ টাকা লাগে। কিন্তু আমাদের আয় বাড়েনি।’’
তিনি জানান, যা আয় হয় তা তাদের হাতে থাকে না। বেতন পেয়েই প্রতিমাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা ঋণ শোধ করতে হয়। আবার মাসের শেষে ধার করতে হয়। এর ফলে গত এক বছরে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন বলে দাবি তার।
তার কথা, ‘‘এভাবে চলতে থাকলে জানি না কীভাবে চলব। ঋণ তো বাড়তে থাকবে। শোধ করব কীভাবে!’’
নিজের সহকর্মীদের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার সহকর্মীদেরও একই অবস্থা। তবে আমার পরিচিত যারা ব্যবসা করেন তাদের সমস্যা হচ্ছে না তেমন।’’
নাজমুল হক তপনকে তার তিন সদস্যের পরিবারকে মাসে ৫০ হাজার টাকায় চালাতে হয়। করোনার সময় তার বেতনও কমে গেছে। আগে বেশি বেতন পেতেন। আর এখন উল্টো নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
তার কথা, ‘‘আমি ঋণ এড়াতে গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আগে মাসে চার কেজি কিনতাম। এখন কিনি না। চার প্যাকেটের বদলে এখন দুই প্যাকেট দুধ কিনি। মাছ কেনা কমিয়ে দিয়েছি। মাংস বলতে এখন ব্রয়লার মুরগি। আর অফিসে হেঁটে যাই।’’
নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের এই করুণ গল্প তেমন আর আলাদা নয়। সবাই বলতে গেলে এখন হয় ঋণ করে সংসার চালাচ্ছেন অথবা ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার কমিয়ে কোনোভাবে টিকে আছেন। ‘এটা অব্যাহত থাকলে মানুষ আরও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে’ কিন্তু এভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকলে তারা কতদিন টিকতে পারবেন বলা মুশকিল।
বাদল হোসেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বেতন পান মাসে ১৮ হাজার টাকা। গত তিন বছরে তার এক টাকাও বেতন বাড়েনি। কিন্তু খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ ভাগ। চার ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সদস্য ছয়জন।
তার কথা, ‘‘কোনোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা কিনতে হয় তা কিনি। কিন্তু তারপরও ঋণে আমি জর্জরিত। দোকানদারও আর বাকি দিতে চায় না। ১০ দিনের মধ্যেই বেতনের টাকা শেষ হয়ে যায়। কীভাবে বেঁচে আছি জানি না। আল্লাহই বাঁচিয়ে রেখেছেন।’’
বাংলাদেশে শুধুমাত্র চলতি বছরেই ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে দুইবার। বলা হচ্ছে, বর্তমান দর প্রতিকেজি ১৯৮ টাকা। কিন্তু ১৯৮ টাকা দামে এক লিটার সয়াবিন তেল বাস্তবে পাওয়া যায় না। বাস্তবে ২২০ টাকা। টিসিবির দামের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নাই। পেঁয়াজ, চাল, চিনি, ডাল, ডিম, মাছ, মাংসের দাম আরও এক দফা বেড়েছে। প্রতিটি ভোগ্য পণ্যের দাম গত এক সপ্তাহে প্রতি কেজিতে গড়ে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। গরুর মাংসের কেজি এখন ৭২০ টাকা। শাকসবজির দাম প্রতিদিনই বাড়ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘‘গত বছর আমাদের হিসেবে জীবনযাত্রার ব্যয় শতকরা ৯ ভাগ বেড়েছে। আমরা বছর শেষে এটা হিসাব করি। তবে আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, এবছরের পাঁচ সাড়ে পাঁচ মাসেই জীবনযাত্রার ব্যয় ১০ ভাগেরও বেশি বেড়েছে। তবে মানুষের আয় বড়ছে না। বরং অনেকের আয় কমে গেছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘মানুষ এখন খাওয়া কমিয়ে খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখছে। আবার অনেকে ধার-দেনা করে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।’’
এ বিষয়ে সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘সরকার বলছে এখন মূল্যস্ফীতি ৬.২ ভাগ। কিন্তু বাস্তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিশেষ করে করে ভোগ্যপণ্যের দাম গত এক বছরে ২০ থেকে ৪০ ভাগ বেড়েছে। কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশিও বেড়েছে। তাহলে বোঝা যায় সরকারের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবের মিল নাই। তাই সরকারের হিসাবের যে কৌশল তা নতুন করে ভেবে দেখা উচিত।’’
তার কথা, ‘‘এই সময়ে মানুষের আয় বাড়েনি। এটা অব্যাহত থাকলে মানুষ আরও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে এবং তা থেকে বের হতে পারবে না। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। যারা এখনো সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন তাদের সঞ্চয় শেষ হয়ে যাবে। খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ফলে অপুষ্টি বাড়বে।’’
এই অর্থনীতিবিদের আশা, চলমান অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারকে আগামী বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ‘‘দ্রব্যমূল্য নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বই এখন সংকটে আছে।’’