নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম হত্যার প্রধান কারণ হিসাবে সামনে এসেছে মাছের ঘের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি। হত্যা মামলায় যুবদলের দুই নেতাকে আসামি করায় আরেক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, শুধুই ঘের নিয়ে দ্বন্দ্ব নাকি রাজনৈতিক বিরোধের জেরে পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। তরিকুল হত্যাকাণ্ডের পর ১৯টি বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কারা জড়িত এখনো রহস্য উদঘাটন হয়নি। দুটি ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ইতোমধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গ্রেফতাররা হলেন-এজাহারভুক্ত আসামি ফিরোজ খান, দীনেশ, সাগর ও শুটার সুমন।
জানতে চাইলে অভয়নগর থানার ওসি আবদুল আলিম বলেন, তরিকুল হত্যা মামলায় এজারহারভুক্ত তিন আসামিসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাছের ঘের সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অগ্নিসংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্লু উদ্ঘাটন সম্ভব হয়নি। তদন্ত চলছে। পরে বিস্তারিত জানাতে পারব।
হত্যার নেপথ্যে ঘের ইজারার দ্বন্দ্ব : স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় দুই দশক ধরে মশিয়াহাটি বাড়েদাপাড়া এলাকায় ২০ বিঘা আয়তনের ঘেরে মাছ চাষ করেন তরিকুল ইসলাম। তার ঘের দেখাশোনা করেন স্থানীয় বাসিন্দা পিল্টু বিশ্বাস। তারা দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে ওঠেন। তাদের পারিবারিকভাবে সুসম্পর্ক ছিল। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একই এলাকার প্রায় দুশ বিঘা আয়তনের ঘের মালিক চিকন বাবু সমস্যায় পড়েন। স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপের মুখে তার ইজারার মেয়াদ শেষ না হলেও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ওই ঘেরটি ইজারা নেওয়ার জন্য দুটি পক্ষ মুখোমুখি হয়ে যায়। তরিকুল ইসলামের পক্ষে পিল্টু বিশ্বাস ঘেরের জমির মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ওই সময় আরেক ঘের মালিক ফিরোজ খান একই ঘেরের ইজারা নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তরিকুল ও ফিরোজ খান বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একই ঘের দুজন ইজারা নিতে চাওয়ায় তাদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়। একপর্যায়ে গত ১৬ মে বাড়েদাপাড়া স্কুল মাঠে ঘেরের জমির ইজারা ডাক (নিলাম) হয়। ওই নিলামে তরিকুল ইসলাম ও ফিরোজ খান অংশ নেন। ডাকে ফিরোজ খান বেশি টাকা দিতে রাজি হন। এ নিয়ে তরিকুল ও ফিরোজ খানের মধ্যে তর্কাতর্কি হয় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
পরে স্থানীয় প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত পিল্টু বিশ্বাস ঘেরের জমির মালিকদের রাজি করান, তারা যেন তরিকুল ইসলামকে ওই ঘেরের জমি ইজারা দেয়। একপর্যায়ে পিল্টু বিশ্বাস জমির মালিকদের কাছ থেকে ইজারা চুক্তিপত্র (ডিড) স্বাক্ষর করিয়ে নেন। জমির মালিকদের স্বাক্ষর নেওয়া শেষ হলে ২২ মে বিকালে তরিকুল ইসলামকে ফোনে ডেকে নেন পিল্টু বিশ্বাস। ডিডের কপি নেওয়ার জন্য ফোন পেয়ে সঙ্গী সুমনকে সঙ্গে নিয়ে পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে যান তরিকুল ইসলাম। এরপর দুর্বৃত্তরা গুলি ও কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ধারালো অস্ত্র দিয়ে ৩৫টি কোপ দেয়। ছয়জন মিলে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায় মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মধ্যে।
যুবদল নেতাসহ আসামি ১১ : তরিকুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় গত ২৬ মে অভয়নগর থানায় ১১ জনের নামে মামলা করেছেন নিহতের ভাই রফিকুজ্জামান টুলু।
আসামিরা হলেন-ডহর মশিয়াহাটি গ্রামের বীরেশ্বর বিশ্বাসের ছেলে পিল্টু বিশ্বাস, দিলীশ্বর বিশ্বাসের ছেলে দীনেশ, কার্তিকের ছেলে দুর্জয়, সুজিত বিশ্বাসের ছেলে সাগর, নিরঞ্জনের ছেলে অজিত, বিকাশের ছেলে পল্লব, বিনয়ের ছেলে গজো ওরফে পবন বিশ্বাস, গোবিন্দপুর গ্রামের নিরাপদ মণ্ডলের ছেলে অতীত মণ্ডল, নওয়াপাড়ার রাজঘাট সাহেবপাড়া এলাকার জাকির কোরাইশির ছেলে আকরাম আক্তার কোরাইশি পান্নু, অভয়নগর উপজেলার বনগ্রামের বেনজিরের ছেলে মাসুদ পারভেজ সাথী ও যশোর সদর উপজেলার রামনগর পিকনিক কর্নার এলাকার সিদ্দিক খানের ছেলে ফিরোজ খান। এদের মধ্যে পান্নু ও সাথী যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মামলায় যুবদলের দুই নেতার নাম থাকায় বিক্ষোভ করেছেন বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা।
১৯ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করল কারা : ডহর মশিয়াহাটি বাড়েদাপাড়ার পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে খুন হন কৃষকদল নেতা তরিকুল ইসলাম। এক ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পিল্টু বিশ্বাসের প্রতিবেশী ১৩টি হিন্দু পরিবারের ১৯টি বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ১০০-১৫০ জনের নামে অভয়নগর থানায় মামলা করেছেন ডহর মশিয়াহাটি গ্রামের সুশান্ত বিশ্বাসের স্ত্রী কল্পনা বিশ্বাস।
বাদী এজাহারে উল্লেখ করেছেন, তরিকুল খুনের সংবাদ পেয়ে তার ভাই, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মীরা দ্রুত পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পায়। একপর্যায়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ১০০-১৫০ অজ্ঞাতনামা আসামিরা হামলা ও লুটপাট চালায়।
তবে স্থানীয়রা জানান, তরিকুল হত্যার খবর পেয়ে পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তা, দলের শীর্ষ নেতারা পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে হাজির হন। এ সময় দুর্বৃত্তরা পুলিশ ও বিএনপির নেতাদের উপস্থিতিতে পিল্টুর বাড়িতে আগুন দিতে পারেনি। আশপাশের হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এই হামলায় নিহত তরিকুলের কর্মী-সমর্থকরা জড়িত নাকি ও সুযোগসন্ধানী চক্র আগুন দিয়েছে, সেটি নিয়ে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন: সাবেক এমপি শাহীনের বিরুদ্ধে মামলা অস্ত্র মামলা