নজর নেই কারা হাসপাতাল ও খাবারের মেন্যুতে
দু’জন ডাক্তারের কেউই কর্মস্থলে নেই
সুনীল ঘোষ: গোড়ায় গলদ রেখে ‘বদলে গেছে’ যশোর জেলখানা। নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কারাগার দিনে দিনে রূপ পেয়েছে সংশোধনাগারে। তবে দৈন্যতা কাটেনি কারা হাসপাতালের ভঙ্গুরদশা ও অমানবিক খাবারের মেন্যুতে। মানুষের ৫ মৌলিক অধিকারের মধ্যে কারাবন্দিরা অন্তত দুটি থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রধান দুই সমস্যা ও সংকট জিইয়ে রেখে কিভাবে কারাগার হবে পরিপূর্ণ সংশোধনাগার-তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সদ্য কারামুক্ত বেশ কয়েকজনের দাবি জেলখানায় যার যত টাকা, তার ততো প্রভাব। যার টাকা নেই তার ভালো থাকার সুযোগ নেই। ঘরে-বাইরে ক্যান্টিন কেন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এসব অমানবিক ও চাঞ্চল্যকর ঘটনার খন্ড চিত্র। তবে কারা কর্তৃপক্ষের দাবি কয়েদি-হাজতি সবাই জেল কোডের অধিকার ভোগ করছেন।
যশোর কারাগারের জেলার মিহির কান্তি খান বলেন, সরকার নির্ধারিত খাবারের তালিকা বহাল রয়েছে। বর্তমান সরকার খাবার মেন্যুতে বেশকিছু পরিবর্তন এনেছে। এক সময় সকালে শুধু রুটি ও গুড় বা চিনি দেয়া হতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ২০১৯ সালের জুন মাসে কারাগারে সকালের নাস্তায় বন্দিদের জন্য খিচুড়ি ব্যবস্থার উদ্বোধন করেন। সেই থেকে সপ্তাহের দু’দিন সকালে খিচুড়ি ও দু’দিন হালুয়া-রুটি সরবরাহ করা হয়। তিনদিন দেয়া হয় রুটি ও সবজি। দুপুরে ভাত, সবজি, ডাল থাকে। রাতের খাবারে ভাত, সবজি, ডাল, মাছ বা মাংস থাকে। হাজতিদের মতো কয়েদিরাও একই খাবার খান। তবে কয়েদিদের ক্ষেত্রে বরাদ্দ একটু বেশি। তারা সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করছেন। তাদের কাজ করতে হয়।
তিনি বলেন, দুপুরে একজন হাজতি বন্দির জন্য চাল বরাদ্দ থাকে ২৪৭ গ্রাম। কয়েদির জন্য চালের বরাদ্দ রয়েছে ২৯১ গ্রাম। এ হিসেবে ভাতের সামান্য কম-বেশি হয়। কিন্তু মাছ, মাংস বা অন্য খাবার হাজতি-কয়েদি সবার জন্য সমান। ফাঁসির আসামিরাও কয়েদিদের সমান সুবিধা ভোগ করেন। এর বাইরে প্রতিটি কারাগারে প্রিজনার ক্যাশ (পিসি) বা ব্যক্তিগত তহবিল নামে একটি পদ্ধতি চালু আছে। বন্দিদের স্বজনরা পিসি’র মাধ্যমে টাকা জমা দিতে পারেন। এই টাকায় নিজের ইচ্ছে মতো কারা ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে খেতে পারেন।
তিনি বলেন, ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের মেন্যুটা কিছুটা আলাদা। তাদের জন্য সরকারের যে বরাদ্দ, সেটা দিয়ে তারা নিজেরাই ঠিক করে নেন সকাল, দুপুর বা রাতে কী খাবেন। জেল কোড মেনে খাবার সরবরাহ করা হয়।
তিনি বলেন, সারাদেশের কারাগারে একই রকম খাবারের মেন্যু রয়েছে। একজন বন্দির জন্য মাছের বরাদ্দ থাকে মাত্র ৩৬ গ্রাম। মাছ কেটে-কুটে নাড়ি-ভুড়ি ও আঁশ বাদ দিলে ২০ গ্রামের বেশি থাকে না। এ সময় তিনি খাবারের মেন্যুর একটি তালিকা দেন। এই সামান্য বরাদ্দ থেকে কীভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি করা সম্ভব নয়।
খাবার মেন্যুর তালিকা বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়েছে ‘ওরা কেউ ভালো নেই। যেকোন বিবেক সম্পন্ন মানুষ খাবারের তালিকা দেখলে নিশ্চিত আৎকে উঠবেন। তালিকায় দেখা যায়, একজন হাজতির জন্য সরকার মাছের বরাদ্দ দেয় ৩৬ গ্রাম, গরুর মাংস হলে ৩৮ গ্রাম, খাসি বা ছাগির মাংস হলে ৩৬ গ্রাম এবং ব্রয়লারের মাংস ৩৭ গ্রাম। কয়েদির জন্য চালের বরাদ্দ ২৯১ গ্রাম এবং হাজতির জন্য ২৪৭ গ্রাম। সকালে নাস্তা হিসেবে কয়েদির জন্য ১২০ গ্রাম ও হাজতির জন্য ৯০ গ্রাম রুটি এবং সাথে হালুয়া বা সবজি দেয়া হয়।
কারা সূত্রের দাবি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে শুরু হওয়া খাবারের মেন্যু এখন আর নেই। দেশ স্বাধীনের পর অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ঘরে-বাইরে কারারক্ষীদের দ্বারা পরিচালিত ক্যান্টিন থেকেও বন্দিরা ইচ্ছে মতো খাবার কিনে খেতে পারেন। তাদের ভাষায় খাবারের কষ্ট এখন আর নেই। প্রতিটি কারাগারে প্রিজনার ক্যাশ (পিসি) বা ব্যক্তিগত তহবিল নামে একটি পদ্ধতি চালু আছে। সেখানে বন্দিদের নামে টাকা জমা রাখার সুযোগ রয়েছে। পিসিতে বন্দির আত্মীয়-স্বজনরা টাকা জমা রাখতে পারেন। সেই টাকা দিয়ে বন্দিরা নিজেদের পছন্দের খাবার বা পণ্য কিনে ব্যবহার করতে পারেন।
কারাগারের ভেতরে-বাইরে ক্যান্টিন স্থাপনকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি। যশোরের এক কারারক্ষী জানান, বন্দিদের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা-ভাবনা করে কারা অধিদফতরের নির্দেশে ২০০৬ সালে ক্যান্টিনের যাত্রা শুরু হয়। ১/১১ সরকারের আমলে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকে কারাবন্দি হন। সেই সব নেতারা কারাগারে খাবারের দৈন্যতা স্বচোখে দেখেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ক্যান্টিনের বৈধতা দেন।
সদ্য কারামুক্ত বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বদলে গেছে যশোর কারাগার। কিন্তু বন্দিদের মূল দুই মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেই। রাজনীতি করার কারণে প্রায়ই তাদের জেলের ঘানি টানতে হয়। যে কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কারাগারের খাবার খেয়ে সুস্থ থাকা অসম্ভব। যার টাকা আছে তার ক্যান্টিনের খাবার খেয়ে ভালো থাকার সুযোগ আছে। কিন্তু কারাগারে যারা আসেন তাদের অধিকাংশই অস্বচ্ছল পরিবারের। সেইসব পরিবারের মামলা পরিচালনা ও জেলখানায় আসা-যাওয়া করার মতো আর্থিক সক্ষমতা নেই। এসব বন্দিদের জেলখানার খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়। অনেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু কারাহাসপাতালে বছরের পর বছর ডাক্তার না থাকায় চিকিৎসা পান না। যেকারণে অনেক হাজতি ও কয়েদির মৃত্যু হয়।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক শিরিন নিগার বলেন, মাছ ও মাংসের বাইরেও ডাল ও সবজিতে আমিষ আছে। তাছাড়া পুষ্টিহীনতা তাৎক্ষণিক বুঝা যায় না। পুষ্টির ঘাটতি দিনে দিনে বেড়ে গেলে তখনই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। যশোর কারাগারে খাবারের মেন্যুর দৈন্যতা সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
সদ্যকারামুক্ত চাঁচড়ার আব্দুল্লাহ (ছদ্ম নাম) জানান, বহুবার জেলে যেতে হয়েছে। তবে ডাক্তার দেখিনি। তারপরও ঘুষ দিয়ে অনেকেই মেডিকেলে থাকতেন। সেখানে সুযোগ-সুবিধা অন্যসব বন্দিদের চেয়ে একটু বেশি। তবে মেডিকেলে সেই ঘুষ-অনিয়মের চিত্র পাল্টে গেছে।
ঝিকরগাছার কৃষ্ণনগর গ্রামের জাহিদ মোল্লা (ছদ্ম নাম) সদ্য জামিনে বেরিয়েছেন। তিনি বলেন, নামে মাত্র কারা হাসপাতাল। সেখানে কিছুই নেই। ৩ মাসে একবারও দেখিনি কোনো ডাক্তার। শুনেছি ডাক্তাররা ট্রেনিংয়ে গেছেন।
সদ্য কারামুক্ত এ দু’জনের দাবি-কারাগারে টাকা ওড়ে। যার টাকার যোগান আছে তার কাছে কারাগার আর বাড়ি সমান। যার টাকা নেই তার নানাভাবে কষ্টভোগ করতে হয়। রোগ-শোকে অনেকের মৃত্যুও হয়। তিনি মনে করেন, মানুষের ৫ মৌলিক অধিকারের মধ্যে খাদ্য ও চিকিৎসা পাওয়া অন্যতম। কারাবন্দিরা এই দুই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কারাগারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ৫০ শয্যার কারা হাসপাতালে একজন বিশেষজ্ঞসহ ৬ জন ডাক্তার থাকার নিয়ম রয়েছে। যশোর কারাগারে কয়েদি-হাজতির ধারণ ক্ষমতা ১৯১৩ জনের। বর্তমানে মোট বন্দির সংখ্যা ১ হাজার ৩৬০। জামিন ও নতুন বন্দির আসা-যাওয়ার কারণে কম-বেশি হয়। এজন্য যশোরে ৭০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু নেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থা। বাস্তব চিত্র খুবই করুণ বলেও মন্তব্য সূত্রের।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখানে ৭০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা দুইজন। তাদের একজন প্রশিক্ষণে বাইরে রয়েছেন। মাহবুব আলম নামে একজন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বেশিরভাগ সময় রোগী দেখেন বেসরকারি হাসপাতাল ইবনেসিনায়।
ডাক্তার সংকটের সত্যতা স্বীকার করে জেলার মিহির কান্তি খান জানান, আগের মতো মেডিকেলে এখন আর কেউ থাকতে চায় না। একজন চিকিৎসক ট্রেনিংয়ে রয়েছেন-জানান এই জেল কর্মকর্তা।
জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী বলেন, আমি গাড়িতে। কথা বুঝা যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি জেলারের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।