কল্যাণ ডেস্ক: বর্তমান আধুনিক যুগে কৃষিতে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন যন্ত্রের ব্যবহারে বৃদ্ধি পেয়েছে ফসল উৎপাদন। লাভবান হচ্ছে কৃষকরা।
একটা সময় গরু আর মহিষ দিয়ে কৃষকরা হাল চাষ করতো। কিন্তু কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাষাবাদে আমূল পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে অনেকটাই যেন বিলুপ্তির পথে গরু ও মহিষের হাল চাষ। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ধরখার এলাকায় ফসলের মাঠে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।
চলতি মৌসুমে বোরো ধান আবাদে স্থানীয় কৃষকরা জমি প্রস্তুতে ঘোড়া দিয়ে হাল চাষ করছেন। বহুকাল আগ থেকে ঘোড়া নানা কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে। এরমধ্যে যুদ্ধে ক্ষেত্রে, মানুষের বাহন হিসেবে ও দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল অন্যতম। এই আধুনিক যুগে এসেও ঘোড়া দিয়ে জমিতে হালচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন আল-আমিন নামে এক কৃষক।
আল-আমিন উপজেলার টানমান্দাইল গ্রামের মৃত ইউনুস মিয়ার ছেলে। তার পরিবারে স্ত্রী, ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে তিনি হালচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
জানা গেছে, এ উপজেলায় বোরো ধান আবাদ শুরু হওয়ায় সর্বত্র চলছে উৎসবের আমেজ। এরই মধ্যে কৃষকরা জমিতে হাল চাষ, সেচপানি, মই দিয়ে জমি প্রস্তুুত করে চারা রোপণের কাজ শুরু হয়েছে। আধুনিক যুগে চাষাবাদে দিন দিন গরু লাঙ্গল ও জোয়াল হারিয়ে গেলেও চাষাবাদে মই দেওয়ার কাজ এখনো চলছে।
জানা যায়, চলতি মৌসুমে বোরো ধান আবাদে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। জমি প্রস্তত করাসহ চারা রোপণ কাজে কৃষকরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে আমন ধানের ফলন ও বিক্রিতে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। তাই বোরো ধান আবাদে মাঠে নেমে কাজ করছেন।
কৃষক আল-আমিন বলেন, বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যে সেচ, হালচাষ ও মই দিয়ে জমি প্রস্তুতের কাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছেন কৃষকরা। যে সব জমিতে এখনও মই দেওয়া হয়নি অনেকেই ঘোড়া দিয়ে মই দিচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, আমি একজন প্রান্তিক কৃষক। বর্তমান বাজারে গরুর দাম অনেক বেশি। এক জোড়া হালের গরু ক্রয় করতে নিচে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার উপর লেগে যায়। কিন্তু ১ জোড়া ঘোড়া ক্রয় করতে লাগে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। তাই গরুর পরিবর্তে ঘোড়া দিয়ে মই দেওয়ার কাজ করছি।
তিনি আরো বলেন গত দুই বছর আগে ৫১ হাজার টাকা দিয়ে এক জোড়া ঘোড়া কেনা হয়। ওই ঘোড়া দিয়ে ৩ থেকে ৪ বছর হালচাষ করা হবে। তবে ঘোড়া দিয়ে নিজের জমিতে হালচাষ করছি না, অন্যের জমিতেও টাকার বিনিময়ে চাষ করছি।
ঘোড়া দিয়ে প্রতি এক বিঘা জমিতে চাষ দিতে নেয়া হচ্ছে ৩শ টাকা। দৈনিক সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৭ থেকে ৮ বিঘা জমিতে হালচাষ করছেন। এ মৌসুমে ৮০ বিঘার ওপর জমিতে হালচাষ দিতে পারবেন। যা থেকে তিনি অন্ত:ত ২৫ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
তিনি আরো বলেন, মৌসুম ছাড়া ও সবজিসহ কৃষির অন্যান্য কাজে হালচাষে মই দেওয়ার কাজ করছেন। এ কাজের আয় দিয়ে চলে তার সংসার। ঘোড়ার দৈনিক খাবার, ওষুধসহ অন্যান্য খরচ প্রায় ৮০ টাকা লাগছে।
আল-আমিন বলেন, প্রথম দিকে ঘোড়াগুলোকে হালের কসরত শেখাতে তাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। ঘোড়ায় লাঙল-জোয়াল জুড়ে দিয়ে অনেকবার চেষ্টার পর আয়ত্তে আসায় এখন পুরোদমে মাঠে কাজ করছেন।
কৃষক মো. হোসেন মিয়া বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তিনি ঘোড়ার মাধ্যমে হালচাষ দিয়ে জমি প্রস্তুত করে ধান আবাদ করছেন। পাওয়ারটিলার বা মাহেন্দ্র গাড়ি দিয়ে হালচাষে যে টাকা খরচ হয় ঘোড়া দিয়ে খরচ অর্ধেক কম লাগে। তাছাড়া এই এলাকায় জমিতে হালচাষ দেওয়ার মতো বড় কোনো গরু নেই। তাই বাধ্য হয়ে ঘোড়া দিয়েই জমিগুলোতে লাঙল দিতে হয়। ঘোড়া দিয়ে হালচাষ দিলে জমি সমান থাকে ফসল ভালো হয়।
কৃষক আলফু মিয়া বলেন, এমনিতেই কৃষি উপকরণের সব কিছুর দাম বেড়েছে। পাওয়ারটিলার বা মাহেন্দ্র গাড়ি দিয়ে হালচাষ দিতে বিঘা প্রতি ৪৫০ থেকে ৫শ টাকা লেগে যায়। আর ঘোড়ার মাধ্যমে হালচাষ দিলে ৩শ টাকা দিতে হয়।
‘ঘোড়া দিয়ে লাঙল দিলে জমি ভালোভাবে খনন হয়। তাছাড়া জমিতে পানি ধরে রাখা ও সহজ হয়। গত ৩ বছর ধরে ঘোড়া দিয়ে জমিতে মই দেওয়ার কাজ করছি।
কৃষক মো. সিরাজ মিয়া বলেন এ মৌসুমে ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করতে প্রস্তুত প্রায় শেষ পর্যায় । এখন শুধু জমিতে মই দেওয়ার কাজ বাকী। ঘোড়া দিয়ে মই দিতে ইতিমধ্যে কথা হয়েছে। আজকালের মধ্যে মই দেওয়ার কাজ শেষ করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে জমিতে চারা লাগানো হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা বেগম বলেন, এ উপজেলায় চলতি মৌসুমের বোরো ধান আবাদ শুরু হয়েছে। জমি প্রস্তুত, চারা উত্তোলন ও রোপণের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
আধুনিক প্রযুক্তির যুগে যান্ত্রিক উপায়েই কৃষকরা এখন জমিতে হালচাষ করছেন। তবে এখনো অনেক কৃষক জমি প্রস্তুত করতে ঘোড়ার দিয়ে হালচাষ করে গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তবে কৃষি বিভাগ সব সময় আধুনিক মানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে চাষাবাদ করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে আসছেন বলে জানায়।
শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে এবং সেচ ব্যবস্থা ঠিকমতো ভালো থাকলে বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে।
আরও পড়ুন: খুলনায় তেলবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত,আড়াই ঘণ্টা পর যোগাযোগ স্বাভাবিক