চার মাসে নিহত সাত
জখম অর্ধশত
জাহিদুল কবীর মিল্টন: যশোরে ছুরির ফলায় নিহত ও জখমের সংখ্যা দীর্ঘ হচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৫ মার্চ পর্যন্ত চার মাসে ছুরিকাঘাতে অন্তত সাতজন খুন হয়েছেন। ছুরির ফলায় জখমের সংখ্যাও কম নয়। এ পর্যন্ত জখম হয়েছে অর্ধশতের বেশি।
উঠতি বয়সি যুবকরা অনলাইন সপিং দারাজের মাধ্যমে বার্মিজ চাকু এনে হত্যা, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকান্ডে ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক কোন্দল, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, টাকা-পয়সা ভাগাভাগি ও ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সব হত্যাকান্ড ও ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটছে।
পুলিশের দুর্বল ধারায় মামলা রুজু, আইন প্রয়োগে শীথিলতা ও রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশয়ের কারণে হত্যাকান্ডের ঘটনা দীর্ঘ হচ্ছে। চাকু প্রাপ্তির সহজলভ্যতা এবং পুলিশের দুর্বল নজরদারির কারণে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে- বলেছেন নারী নেত্রী ও এনজিও কর্মকর্তা বীথিকা সরকার। অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার কনা বলেন, শহরের দোকানগুলোতে এই চাকু বিক্রি হয় না। তবে অনলাইনে চটকদারি ও নজরকাড়া বিজ্ঞাপন এবং কুরিয়ারে চাকু প্রাপ্তির শতভাগ নিশ্চয়তায় কিশোর-যুবারা এদিকে ঝুকছে। এজন্য উৎস বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। অ্যাডভোকেট আমিনুর রহমান হিরু বলেন, ছোট অস্ত্রের চেয়ে বার্মিজ চাকু বহন ঝুঁকিমুক্ত। দামও কম। মামলা হলেও দন্ড কম। তাই এর ব্যবহার বাড়ছে।
২৪ মার্চ দুপুরে শহরের পুরাতন কসবা কাজীপাড়া গোলামপট্টি এলাকায় মোহাম্মদ আলীর ছেলে আলম হোসেনকে (৪৮) পূর্বশত্রুতার জেরে ছুরিকাঘাতে জখম করে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা। ২৭ মার্চ তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
২৫ মার্চ রাতে শহরের পুরাতন কসবা কাঁঠালতলায় একই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা টাকা পয়সার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে রুম্মান (৩১) নামে এক যুবক কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে খুন করে। রুম্মানের বাড়ি শহরের টালিখোলায়। এ সময় আরিফ হোসেন সাকিল (৩০) নামে আর এক যুবক ছুরিকাঘাতে আহত হয়। তার বাড়িও একই এলাকায়। রুম্মান হত্যাকান্ডের ঘটনায় তার ভগ্নিপতি পুরাতন কসবা পুলিশ লাইন গেটের লাইকুজ্জামানের ছেলে আলীমুজ্জামন আলি ১১ জনের নাম উল্লেখ করে ২৬ মার্চ সন্ধ্যয় মামলা করেন।
এর ১০ দিন আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে শহরের শংকরপুর চোপদারপাড়া ব্রাদার্স ক্লাবের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে স্বর্ণকার রানা ও তার সহযোগীরা দা ও চাকু দিয়ে যুবলীগ কর্মী ইয়াসিন আরাফাতকে হত্যা করে। এঘটনায় ইয়াসিনের স্ত্রী শাহানা আক্তার নিশা ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে ১৭ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন। পুলিশ ইয়াসিন হত্যার এজাহার ভুক্ত আসামিদের আটক করে।
২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর চৌগাছা উপজেলার পাতিবিলা বাজারে একটি চায়ের দোকানে ১৫-২০ জনের একদল সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ইউপি মেম্বার ঠান্ডু বিশ^াসকে (৫০) হত্যা করে। এঘটনায় চৌগাছা থানায় মামলা হয়। এ মামলায় র্যাব ও পুলিশ ৪ আসামিকে আটক করে।
এর আগে ৮ জানুয়ারি সকালে সদর উপজেলার নারাঙ্গালীতে যশোর-ছুটিপুর সড়কে তৃতীয় লিঙ্গের আবদুল কাদের ওরফে লাভলীকে দুষ্কৃতকারীরা এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে লাভলী শহরতলীর ধর্মতলা ফারুকের বাড়ির ভাড়াটিয়া ।
লাভলী হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের বোন নিউ বেজপাড়া রোডের সেলিনা (৩৫) ৯ জানুয়ারি কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলায় ৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। পুলিশ এ মামলায় সব আসামিকে আটক করে। আটককৃতদের কাছ থেকে পুলিশ হত্যার কাজে ব্যবহৃত একটি বিদেশি পিস্তল ৫ রাউন্ড গুলি, ৩ রাউন্ড গুলির বুলেট, ১টি বার্মিজ চাকু, ১ টি করাত, কুড়াল ও ২ টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহরতলীর হুশতলা বিষের মোড়ে পূর্ব শত্রুতার কারণে প্রতিপক্ষ ছুরিকাঘাতে আব্দুর রহমান রাকিবকে (২৮) হত্যা করে। রাকিব হুশতলা কবর স্থানের পশ্চিপাশের বাসিন্দা। রাকিব হত্যার ঘটনায় চাচা হাফিজুর রহমান ওরফে বটু ১৮ ডিসেম্বর ৯ জনের নাম উল্লেখ করেন মামলা করে। রাকিব হত্যা মামলায় পুলিশ ৩ জনকে আটক করে।
১৯ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১১ টায় শংকরপুর নতুন বাসটার্মিনালে পূর্ব শত্রুতার কারণে ছাব্বির হোসেনকে (১৯) ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে দুর্বৃত্তদরা। ছাব্বির শংকরপুর জমাদ্দারপাড়ার বাসিন্দা। এ ঘটনায় নিহত ছাব্বিরে মা মাসুরা খাতুন ১৯ ডিসেম্বর রাতে ৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। এঘটনায় পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে।
এ সময়ে ছুরিকাঘাতে জখমের ঘটনা ঘটেছে প্রায় অর্ধশতাধিক। গত ১৪ মার্চ সোমবার রাতে শহরের বস্তাপট্টিতে উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে সাইফুদ্দিন রিজু (৩২) নামে এক যুবলীগ কর্মী গুরুত্বর জখম হয়। এঘটনায় থানায় মামলা হয়। পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত অভিযোগে ১ জনকে আটক করে। ২১ মার্চ শহরের ডালমিল এলাকায় ৫ ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক সেলিম হোসেনকে সন্ত্রাসীরা ছুরিকাঘাতে জখম হয়। তিনি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
শহরের ঘোপ জেল রোড বউবাজারে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের কারণে ২ ফেব্রুয়ারি রাতে বড় ভাই শাহ আলমকে (৫৫) আপন ছোট ভাই ছুরিকাঘাত করে নগদ ৩০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এঘটনায় ৫ ফেব্রুয়ারি ওমর ফারুক ২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করে। এ ঘটনায় পুরিশ কাউকে আটক করতে পারেনি।
পুর্ব শত্রুতার কারণে ৭ জানুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘোপ সেন্ট্রাল রোড এলাকার সাবেক এমপি আলী রেজা রাজুর বাড়ির মোড়ে চার যুবক ছুরিকাঘাতে জখম হয়। আহতরা হলো ঘোপ ধানপট্টি বউবাজর এলাকার রাসেল আহম্মেদ (২০), ঘোপ সেন্ট্রাল রোড এলাকার রুবেল হোসেন সাব্বির (২৪), ঘোপ তাদেরকে ছুরিকাঘাতে জখম করে।
১৮ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় শহরের শংকরপুর মুরগি ফার্মের সামনে রেজাউল ইসলাম (৩৬) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাত করে র্দুবৃত্তরা। ১১ ডিসেম্বর শহরের শংকরপুওে ২ যুবককে ছুরিকাঘাতে জখম করা হয়। তারা হলো শহরের ষষ্ঠীতলার নাসির হোসেন (২৬) ও হাসিবুর রহমান (১৯)। ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহরের বেজপাড়ায় ছিনতাইকারীরা এক দম্পতিকে ছুরিকাঘাত করে স্বর্নালংকার ও টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়। আহতরা হচ্ছে শহরের আর এন রোডের দোকান কর্মচারি জাহিদ হাসান (২৮) ও তার স্ত্রী নুসরাত ফারিয়া (১৮)। এর আগের দিন ৭ ডিসেম্বর বাঘারপাড়া উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের আরিফুল ইসলাম আরিফ (২০) ও দয়ারামপুর গ্রামের সাইফুল ইসলামকে ছুরিকাগাত করে ছিনতাইকারিরা তাদের মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। তারা উপশহর মানসী সিনেমা হলের পাশে কেরামবোর্ড কিনতে আসে। ফেরার পথে মার্কাজ মসজিদের সামনে পৌঁছালে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। ১ ডিসেম্বর যশোর জেলা যুবলীগের বর্ধিত সভা চলাকালে বার্মিজ চাকুর আঘাতে আহত হয় অন্তত ১২ জন। আহতরা হলো শহরের আর এন রোডের হ্যাপি (১৭) যশোর সদরের বিরামপুরের খায়রুল (২০) ঝুমঝুমপুরের রাসেল (১৭) হামিদপুরের টিটো (১৮) চাঁচড়ার জয় আহমেদ (১৭) ধর্মতলার গোষ্ঠ গোপাল (২০) একই এলাকার সোহাগ (২১) চুড়ামনকাঠির আকিবুল ইসলাম (১৭) মুড়লির রাব্বি (১৮) ও রুপদিয়ার শামমি হোসেন (১৮)।
সচেতন নাগরিকদের অভিমত রাজনৈতিক কোন্দল, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, টাকা-পয়সা ভাগাভাগি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সব হত্যাকান্ড ও ছুরির ফলায় জখমের ঘটনা ঘটছে। পুলিশের দুর্বল ধারায় মামলা রুজু, আইন প্রয়োগে শীথিলতা ও রাজনেতিক আশ্রয় প্রশয়ের কারণে হত্যার মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এখনই এর লাগাম টেনে না ধরলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
এ ব্যাপারে যশোর ডিবি পুলিশের ওসি রুপন সরকার জানান, অনলাইন সপিং দারাজ কর্তৃপক্ষের সাথে তারা কথা বলেছেন। দারাজকে বলা হয়েছে অনলাইনের মাধ্যমে কেউ চাকু অর্ডার দিলে যেন দেয়া না হয়। দারাজ ছাড়াও অন্য কোন অনলাইনের মাধ্যমে চাকু আনা হচ্ছে কিনা এ বিষয়েও নজরদারি করা হচ্ছে।