নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ রুবায়েত হাসান তানভীর। জন্ম থেকেই তার বাঁ চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ। একই সাথে নিয়ম করে প্রতি মাসে দিতে হয় এক ব্যাগ রক্ত। আর্থিক অভাব-অনটনের সংসারে রুবায়েতকে পড়াশোনা করাতে চাননি মা-বাবা। তবে ছেলের জোরাজুরিতেই তাকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। জন্মের পর থেকেই জীবনের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত লড়াই করা রুবায়েত লেখাপড়ার হাল ছাড়েনি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আর ডান চোখের ভরসায় এ বছর এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে যে তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন, সেগুলোর সব কয়টিতে এ প্লাস পেয়েছে। স্বপ্ন দেখেন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। তবে টানাপোড়েনের মধ্য ছেলের এ ফলাফলে খুশির চেয়ে ভবিষ্যতের পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে রুবায়েতের পরিবার।
রুবায়েত হাসান তানভীর যশোরের মণিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের চিনাতলা গ্রামের আব্দুল মালেক ও তানিয়া খাতুন দম্পতির বড় ছেলে। তিনি এবার যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এর আগে মণিরামপুর নাগোরগোপ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৪ দশমিক ৪৪ পেয়েছিলেন। রুবায়েত হাসানের বাবা আব্দুল মালেক যশোরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন (এনজিও) সংস্থায় চাকরি করতেন। ২০১৭ সালে চাকরি হারিয়ে তিনি ইজিবাইক ভাড়ায় চালানো শুরু করেন। রুবায়েত ছাড়াও ছোট একটি মেয়ে আছে তার। সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে আব্দুল মালেককে হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর রুবায়েত জন্ম থেকেই থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। তিন বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে তার শরীরে এক ব্যাগ করে রক্ত দিতে হচ্ছে। এ বাবদ মাসে এক হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। রক্তদাতা নিজেদের ঠিক করে রাখতে হয়। গ্রাম থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূর থেকে যশোর শহরে এসে ইজিবাইক চালিয়ে যে টাকা রোজগার হয়, তা দিয়ে সংসারের খরচ চলে তার।
আব্দুল মালেক বলেন, রুবায়েত খুব মেধাবী। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি তার আগ্রহ বেশ। কিন্তু প্রতি মাসে তার চিকিৎসা ও লেখাপড়ার খরচ জোগাতে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাধ্যমিকে ভালো রেজল্টের পাশাপাশি এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। ভালো ফল করেও তার লেখাপড়া করানো নিয়ে আমি দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যশোরে একটি কোচিংয়ে ভর্তি করালেও টাকার অভাবে ভর্তি কোচিং শেষ করাতে পারেনি। তাই ছেলেকে শহর থেকে গ্রামে নিয়ে এসেছি। নিয়মিত ছেলের চিকিৎসা ব্যয়ের সাথে তার উচ্চশিক্ষার খরচ বহন করার মতো আর্থিক ক্ষমতা আমার নেই। ভিটামাটি ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। মাঠে ধান চাষেরও কোনো জমিজমা নেই।
রুবায়েতের ফলাফলে খুশি পরিবারসহ স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও প্রতিবেশীরা। তবে অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য রুবায়েতের সেই আনন্দ এখন বিষাদে পরিণত হচ্ছে। দরিদ্রতার কারণে আগামী দিনের উচ্চশিক্ষার খরচের চিন্তায় মা তানিয়া খাতুনের চোখমুখে শুধু হতাশার ছাপ। অশ্রু সজল চোখে তিনি বলেন, পাড়ার সব ছেলে মেয়েরা স্বাভাবিক ভাবে চলাফেলা করতে পারলেও রুবায়েত করতে পারে না। সারাদিন বাড়িতেই থাকে। ঠিক মতো কোন প্রাইভেট পড়াতে পারি নি। এরপরও সে ভাল ফলাফল করায় আমরা গর্বিত। তিনি আরো বলেন, সেই ছোট বেলা থেকে রুবায়েতের রক্ত দেওয়া লাগে। প্রায় দুচোখেই তার সমস্যা। কোন কিছু দেখতে হলে ডান চোখেই ভরসা রুবায়েতের। হঠাৎ করেই নাক দিয়ে রক্ত পড়ে; ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারেনি অর্থের অভাবে। ওর বাবার শুধু ইজিবাইক চালানোর টাকায় সংসার চলে না। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখে রুবায়েত। তার পড়াশুনা কিভাবে চলবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। এ ব্যপারে আমি রুবায়েতের স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রী বা সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা প্রার্থনা ও দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করছি।
রুবায়েত হাসান তানভীর বলেন, এইচ এসসিতে সফল হয়েছি। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। তবে শুধু বাবার ইজিবাইক চালানোর টাকায় সংসার চলে না। অভাব অনটনের কথা শুনলে লেখাপড়ায় ঠিকমতো মন দিতে পারি না। বিসিএস হওয়ার সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য কোথায়? আনোয়ারুল ইসলাম নামে তার এক প্রতিবেশি জানান, রুবায়েত পড়াশুনায় ভাল। তার পরীক্ষার ভাল ফলাফলে আমরা আনন্দিত। চোখেও তেমন দেখতে পারে না। দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে সে কষ্ট করে পড়াশুনা করায় আমরা তার জন্য গর্ববোধ করছি। পৃষ্ঠপোষকতা দিলে ভবিষ্যতে অনেক ভালো করতে পারবে। তিনি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর অনুরোধ জানান।