অফিসের গেট বন্ধ থাকে সব সময়
সেবা নিতে গিয়ে দুর্ব্যবহার জোটে
সালমান হাসান: তথ্য ও পরামর্শ দিতে হেল্পডেক্স থাকলেও সেখানে কারোর দেখা মেলে না। এমনকি অফিস চলাকালীনও গেট বন্ধ করে রাখা হয়। আর খোলা থাকলে ভেতরে গেলে করা হয় দুর্ব্যবহার। ফলে জাতীয় পরিচয়পত্রের সংশোধন, স্মার্ট কার্ড গ্রহণসহ অন্যান্য কাজে এসে দুর্ভোগ ও হয়রানীর শিকার হচ্ছেন সেবা প্রত্যাশীরা। যশোর নির্বাচন অফিস সেবা নয় যেন এক হয়রানি কেন্দ্র বলছেন নাগরিকরা।
গতকাল রোববার। বেলা তখন সাড়ে ১১টা। অফিসে ঢোকার মুখের কলাপসিবাল গেটটিতে তালা মারা। জেলা নির্বাচন অফিসের সামনে এসময় নারী-পুরুষের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। ‘সিরিয়াল’ দিয়ে অফিস ভবনের জানালার কাছে পৌঁছনোর পর অনেককে বিরক্তি ও ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা যায়। সেবাপ্রত্যাশীরা জানান, সব সেবার জন্য একটিই মাত্র লাইন। ওই লাইনে দাঁড়িয়ে স্মার্ট কার্ড নিতে হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র হারালে ও সংশোধন বিষয়ে করণীয় জানতেও ওই একই লাইনে দাঁড়াতে হয়। তাছাড়া অফিসের মূল গেট বন্ধ করে রাখা হয়। দড়জা খোলা থাকলে ভেতরে গেলে অপমান অপদস্ত হতে হয়। একটি হেল্প ডেক্স থাকলেও সেখানে কেউ বসেন না। তাদের দাবি, মাসের পর মাস ঘুরেও সমস্যার সমাধান হয় না। তবে অফিসে কর্তব্যরতদের পরামর্শে ‘ফরিদ কম্পিউটারে’ গেলে সমস্যার সমাধান হয়।
মোনতাজ গাজী জানান, এনআইডিতে (ন্যাশনাল আইডেনটিটি) তার নামের বানান ভুল আছে। সেটি সংশোধনের করণীয় জানতে নির্বাচন অফিসে এসেছেন। কিন্তু গেট তালাবদ্ধ থাকায় ভেতরে ঢুকতে পারেন নি। গেটের বাইরে থেকে অফিসের একজনকে জিজ্ঞেস করলে তাকে লাইনে দাঁড়াতে বলেছেন। তিনি বলেন, এত বড় লাইনে দাঁড়িয়ে সংশোধনের জন্য করণীয় জানতে অপেক্ষায় থাকলে বেলা দেড়টা দুইটা বেজে যাবে। তাই আজকের মতন ফিরে যাচ্ছি। তারমতে, একটা তথ্য জানাতে এত সময় লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখানো কোন দায়িত্বশীল আচরণ না।
আরিফ ফয়সল নামে যশোর সদরের নিউ মার্কেট এলাকার এক যুবক জানান, ভোটার এলাকা বদলের জন্য তিনি এখানে এসেছেন। অফিসের ভেতরে একটি হেল্প ডেক্স আছে। কিন্তু সেখানে কেউ বসে না। অফিসের কাউকে জিজ্ঞেস করবেন তারও সুযোগ নেই। খানিক আগে অফিসের একজন এসে কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে গেছে।
নির্বাচন অফিসে সেবা নিতে আসা মানুষের রয়েছে বহুমুখী অভিযোগ। তাদের দাবি, একেক দিন একেক রকম কথা বলেন কর্তব্যরতরা। আর তাদের এই ইচ্ছামাফিক ও ভুলভাল কথাবার্তায় ভোগান্তি পোহাচ্ছেন তারা। তবে টাকা ঢাললে যেকোন কাজ সহজ হয়-এমনও অভিযোগ রয়েছে তাদের। সদরের সুজলপুরের শাহিন হাসান জানান, ২০১৭ সালে তার স্মার্ট কার্ড হয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন ঘুরেও সেটি পাচ্ছে না। তার বাড়ির পাশের একজন কয়েকশ টাকা খরচ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্ড পেয়েছেন। তাই তিনিও সেই চেষ্টা করছেন বলে আরও জানান তিনি।
সোহেল হোসেন নামে আরেক যুবক জানান, তিনি নতুন ভোটার হয়েছেন। জাতীয় পরিচয় পত্র নিতে যে স্লিপ দেয়া হয়েছিল হারিয়ে ফেলেছেন। করণীয় জানতে অফিসের ভেতর ঢুকেছিলেন। অফিসের এক কর্মচারী খারাপ ব্যবহার করে তাকে বের করে দিয়ে গেটে তালা মেরে দিয়েছেন। এখন লাইনে দাঁড়িয়েছেন করণীয় জানতে।
বেলা তখন ১১টা। নির্বাচন অফিসের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরে কর্তব্যরত একজনের সাথে কথা বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন একজন। আলাপচারিতায় মুরাদ বিশ^ান নামে ওই ব্যক্তি এই প্রতিবেদকে জানান, তার স্ত্রীর স্মার্ট কার্ডের স্লিপ হারিয়ে যায়। এরপর তিনি অফিসের নির্বাচন অফিসে কর্মরত একজনের পরামর্শে সিভিল কোর্ট মোড়ের একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে পুরাতন আইডি কার্ড তোলেন। তারপর থেকে বছর খানেক ধরে ঘুরছেন। তিনি বলেন, গত সপ্তাহের মঙ্গলবার তাকে জানানো হয় আজ তিনি স্ত্রীর স্মার্ট কার্ড পাবেন। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে- এলাকায় মাইকিং করে জানানো হবে-কবে স্মার্ট কার্ড দেয়া হবে। তখনই জানতে পারবেন। এখন বলা সম্ভব না।
লিটন হোসেন নামে চাঁচড়া রায়পাড়ার আরেক বাসিন্দা জানান, গত সপ্তাহের বুধবারে তার শ্যালিকার এনআইডির স্মার্ট কার্ড নিতে এসেছিলেন। সেদিন তাকে বলা হয় পরের দিন আসতে। পর দিন বৃহস্পতিবার বলা হয় আজ রবিবার আসতে। বহুসময় লাইনে দাঁড়ানোর পর তাকে বলা হয়েছে, রবি ও মঙ্গলবার এনআইডি কার্ড বিতরণ হয় না। অফিস থেকে তাকে সিভিল কোর্ট মোড়ের একটি দোকান থেকে ‘অনলাইন কপি’ ডাউন লোড করে নিতে বলা হয়েছে বলে আরও জানান তিনি।
জানা গেছে, যশোর শহরের সিভিল কোর্ট মোড়ের ফরিদ ফটোস্ট্যাট এন্ড কম্পিউটারসহ বেশ কয়েকটি দোকানের সাথে নির্বাচন অফিসের কর্মরতদের একটি অংশের যোগসাজস আছে। জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্ট নয়) তুলতে ওই দোকানগুলোতে সেবাপ্রত্যাশীদের পাঠানো হয়। দোকানগুলো প্রতিদিন শতশত মানুষের এনআইনডি ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে সরবরাহ করে। আর এই কাজের বিনিময়ে নির্বাচন অফিসে নিয়মিত কমিশন পৌঁছে যায় এই দোকানগুলো থেকে।
অধরা শ্রেয়সী অথই নামে রাজশাহী বিশ^াবিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, স্মার্ট কার্ড নেয়ার জন্য কয়েকমাস ঘোরাঘুরি করেছেন। কিন্তু এখনও হাতে পাননি। পরে নির্বাচন অফিস থেকে তাকে সিভিল কোর্ট মোড়ের ফরিদ ফটোস্ট্যাট এন্ড কম্পিউটার যেতে বলা হয়। সেখান থেকে তিনি ৩০০ টাকা দিকে একটি এনআইডি (স্মার্ট নয়) তুলেছেন।
সোমা রায় নামে এক নারী জানান, জাতীয় পরিচয়পত্রে তার মায়ের নামের বানান ভুল আছে। এটি জানার জন্য নির্বাচন অফিসে ঢুকলে কর্মরতরা খারাপ ব্যবহার করে বাইরে বের দেন। এরপরও কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে করণীয় জানতে পারেননি। তিনি বলেন, তবে সম্প্রতি নির্বাচন অফিসের একজন কর্মী তাকে নামের বানান সংশোধনের জন্য ফরিদ কম্পিউটারে যেতে বলেছেন।
নাগরিকদের অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে দৈনিক কল্যাণ দপ্তরের টেলিফোন থেকে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের মুঠোফোনে কল করলে তিনি বলেন, ‘কাল আসেন আপনাকে দেখানো হবে’।