কার্যাদেশের নোটিশ বোর্ড নাই
তবুও নদ খননে স্বস্তি
ইলিয়াস উদ্দীন: মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার শৈশব কাটিয়েছেন কপোতাক্ষ নদের তীরে। পরবর্তীতে তিনি যখন ফ্রান্সে ছিলেন, শৈশবের কথা স্মরণ করে কপোতাক্ষ নদ নামের সনেট (চতুর্দশপদী কবিতা) রচনা করেছিলেন,-
‘বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে / কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে / দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।’
দীর্ঘদিন পর কপোতাক্ষ নদ খনন কার্যক্রম শুরু হলেও দেখতে মনে হচ্ছে খাল খনন কাজ চলছে। নদ খননের পূর্বে নদের পানি নিষ্কাশনের কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। খননস্থলে কার্যাদেশের নোটিশ বোর্ড টানানো না থাকায় জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তবে নদ খননে কপোতাক্ষের পাড়ের মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (২য় পর্যায়ে) প্রকল্পের আওতায় নদের ৫ কিলোমিটার পুনখনন কাজ শুরু হয়েছে। উপজেলার ফুলতলা গ্রাম থেকে এ খনন কাজ শুরু করেছে ‘মায়ের দোয়া’ কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলে জানিয়েছেন ম্যানেজার আব্দুস সালাম।
কপোতাক্ষ পাড়ের মাছ শিকারী বাবু বলেন, কপোতাক্ষ নদ ভরাট হওয়ায় আর মাছ শিকার করা যায় না। বাপ-দাদারা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন আমাদের মালো সম্প্রদায়ের মানুষ বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।
ঝিকরগাছা শহরের গৃহিনী সেলিনা সুলতানা নাজু বলেন, দীর্ঘদিন কপোতাক্ষ নদ শুকিয়ে যাওয়ায় পানি দূষিত হয়েছে। এর ফলে এ নদের পাড়ের বর্তমান প্রজন্মের ন্যায়, আমার ৩ সন্তানের একজনও সাঁতার জানে না। যা দুঃখজনক। নদ খননের ফলে আগামী প্রজন্ম সাঁতার শিখতে পারবে।
নদের তীরবর্তী পুরন্দরপুরের বাসিন্দা কৃষক শাহাবুদ্দিন বলেন, নদ খননের ফলে অনেক কৃষক তাদের কৃষি কাজে পানির ঘাটতি পূরণ করতে পারবেন।
নদ খননের আগে পুরোপুরি পানি অপসারণের পর এক্সকেভেটর দিয়ে নদের তলদেশ থেকে মাটি কাটার কথা থাকলেও তেমনটা নজরে পড়েনি। পানির মধ্যেই এক্সকেভেটরের মাধ্যমে নদ খননের কাজ চলছে। এর ফলে সঠিকভাবে নদ খননে ঘাপলা থাকছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এলাকাবাসীর অভিমত, ১৯২৭ সালের রেকর্ড অনুযায়ী নদটি খনন হলে, এর চেহারা খালের মতো দেখাতো না। তাই এ নদের পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে আনতে হলে নদের রেকর্ড অনুযায়ী খননের প্রয়োজন। আবার এলাকার মানুষ এও বলছেন, ঘাপলা হোক আর যাই হোক নদের তো খনন হচ্ছে।
খনন কাজে নিয়োজিত মায়ের দোয়া কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার আব্দুস সালাম জানান, নদের পানি নিষ্কাশনের পরে নদের তলদেশের মাটি অপসারণ করছি। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের সাথে কথা বলতে চাইলে ম্যানেজার বলেন, সাহেবের মোবাইল নম্বর দেয়া নিষেধ আছে।
২০০০ সালে সেপ্টেম্বর মাসের বন্যার পর থেকে কপোতাক্ষ নদের জোয়ার-ভাটা বন্ধ হওয়ায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কপোতাক্ষ নদ দখল।
কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন কমিটির ঝিকরগাছা শাখার সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, নদ খালের মতো করে শুধুমাত্র খনন করলে হবে না এর সাথে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, নদের জায়গা নদে ফিরিয়ে দেয়া ও মাথাভাঙ্গায় উজানের সঙ্গে নদ সংযোগ করে দিতে হবে। তাহলে কপোতাক্ষ আবার যৌবন ফিরে পাবে।
রোববার দুপুরে দৈনিক কল্যাণের সাথে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় ১১ জন ঠিকাদারের মাধ্যমে চৌগাছার তাহেরপুর থেকে ঝিকরগাছা হয়ে মণিরামপুরের চাকলা পর্যন্ত ৭৯ কিলোমিটার নদ পুনঃখনন করা হবে।
২০২১ সালের ১ আগস্ট থেকে খনন কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পানি বেশি থাকায় সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৩ সালের ২ জুন পর্যন্ত। যার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ কোটি ৪৫ লাখ ৭৯ হাজার ৯০৭ টাকা। খননের গড় প্রস্থ প্রায় ৪৫.৫৫ মিটার এবং গড় গভীরতা ১.৪০ মিটার। এছাড়া খননের তলা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ মিটার।
এই নদ এর উৎপত্তি চুয়াডাঙ্গা জেলার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে এবং এটি পরে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় ভৈরব ও কপোতাক্ষ দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কাছে শিবসা নদীতে গিয়ে পতিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ ২৩৮ কিলোমিটার (১৪৮ মাইল), গড় প্রস্থ ১৫০ মিটার (৪৯০ ফুট), গভীরতা ৩.৫ থেকে ৫ মিটার (১১.৫ থেকে ১৬.৪ ফুট)। এই নদ ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত।