দেলোয়ার কবীর, ঝিনাইদহ: আজ থেকে ৫-৬ বছর আগে যেখানে ছিল গ্যাদগেদে কাঁদামাটির রাস্তা, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে হিমসিম খেত, কৃষক হোঁচট খেত ফসল আনা নেয়া করতে, ভোটাররা ভোট দিতে সাহস পেত না খারাপ রাস্তার কারণে, সেই অজপাড়াগাঁয়েও লেগেছে উন্নয়নের বাতাস।
গ্রামীণ সব নারীকে এখন আর বোকা আর অকর্মা বলে দায় চাপানো সহজ হচ্ছে না, কেননা তারা দিনে দিনে ক্ষমতাবান হচ্ছে, যৌতুক, তালাক, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে এসব অনিয়ম আর অবিচারের বিরুদ্ধে তারা এখন সরব। কাজের জবাবদিহিতার সাথে সাথে তারাও বুঝে নিচ্ছে তাদের কাজ, তদারকি করছে ভালোমন্দ কাজের, প্রকল্পের। একথাগুলো বললেন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ধলহরাচন্দ্র ইউনিয়নের তিন নারী সদস্য। তারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন প্রত্যক্ষ ভোটে। তাদের কথার সাথে সুর মেলালেন কয়েকজন পুরুষ সদস্য এবং চৌকিদার, দফাদার বা গ্রামপুলিশরাও।
কাশিনাথপুর গ্রামের আকরাম হোসেন (৫৯) জানালেন, মাত্র কয়েক বছর আগেও তার এলাকা ও আশেপাশের কয়েক গ্রামের ছেলে মেয়েরা বর্ষা-বাদলার দিনে স্কুলে যেতে পারত না কাঁদাপানির রাস্তার কারণে। এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও চলে গেছে পাকা রাস্তা, চলাচলে দিনরাত প্রায় সমান, শহরের মত গ্রামেও ছুটছে চার চাকার গাড়ি যখন তখন। তবে সব গ্রামের রাস্তা এখনও পাকা হয়নি। এগুলো দ্রুত পাকা হওয়া দরকার।
বয়োবৃদ্ধ মনিন্দ্র নাথ জানালেন, বর্ষাকালে ভোট হলে অনেকেই খারাপ রাস্তার কারণে ভোট দিতে হেলাফেলা করত। এখন আর সেসব নেই, মানুষ উতসবমুখর পরিবেশেই যাকে পছন্দ ভোট দিচ্ছে রাস্তাঘাটের উন্নয়নের কারণে। ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার (গ্রাম পুলিশ) শিপন বিশ^াস জানালেন, তারা এলাকার জন্ম-মৃত্যু, আত্মহত্যা, সামাজিক ও রাজনৈতিক হানাহানি বা দাঙ্গার খবর, মাদক বহন বিষয়ে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন এবং ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা উপকারভোগিদের খবর সরবরাহ করেন এবং মেম্বারদের আদেশ-নির্দেশ পালন করেন। তারা সপ্তাহে একদিন থানায় হাজিরা দেন এবং একদিন রাতে নিজের প্রতিষ্ঠানের পাহারায় সদাজাগ্রত থাকেন।
নির্বাচিত তিন নারী সদস্য বুলবুলি খাতুন, হিরামন খাতুন ও আকলিমা খাতুন জানালেন, নির্বাচিত একজন নারী সদস্য তিনিটি ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকলেও পুরুষ সদস্যরা তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দিত, এখন আর সেদিন নেই। যেহেতু নারী সদস্যরাও ভোটে নির্বাচিত, তারা এলাকার সব ভালোমন্দ কাজে সরাসরি অংশ নিচ্ছে, প্রকল্পের কাজ বুঝে নিচ্ছে জবাবদিহিতার সাথে সাথে। এতে তারা দিন দিন ক্ষমতায়িত হচ্ছে। তাদের মতে, একসময় যৌতুক, তালাক, বাল্যবিয়ে, বহু বিয়ে এসব অনিয়ম চলত পুরুষের একক সিদ্ধান্তে, এখন এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে চেতনার উদয় হচ্ছে, তারাও শিক্ষিত হচ্ছে, সোচ্চার হচ্ছে অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে। তবে গত ২-৩ বছরে মাহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে কিছু অভিভাবক অষ্টম থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া তাদের মেয়েদের জন্মনিবন্ধনের কাগজ প্রদর্শন না করে কোর্টে গিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন, কিছু উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েও একইভাবে এফিডেভিট করে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে করছে বিধায় বাল্যবিয়ে পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
ধলহরাচন্দ্র ইউনিয়ন পরিষদ সচিব শরিফুল ইসলাম জানালেন, উপজেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ পরিষদের আওতায় ২৭টি গ্রামের ৩০ কিলোমিটার আয়তনে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ বসবাস করছে। তার মধ্যে ৬৫ ভাগ রাস্তা পাকা হয়ে গেছে, বাদবাকি দ্রুত উন্নয়নের আওতায় আসছে। শতকরা ৭৫ ভাগ শিক্ষিতের ইউনিয়নে বৃহত্তর যশোর ও কুষ্টিয়ার সর্ববৃহত লাঙ্গলবাধ বাজারসহ তিনটি উল্লেখযোগ্য হাট কৃষকসহ সব মানুষের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান জানালেন, এলাকার ছোটখাটো হাঙ্গামা, সামাজিক দ্বন্দ্ব, বাল্যবিয়ে ও বহুবিয়ে নিরোধে তিনি কাজ করছেন। ছোটখাটো বা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মামলা বা আইনের আশ্রয়ে না গিয়ে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে মিমাংসা করার ফলে উভয় পক্ষ লাভবান হচ্ছে, তাদের মধ্যে স্থানীয় বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আস্থা ফিরে আসছে, গ্রামে শান্তি-শৃংখলা বজায় থাকছে। জন্ম-মৃত্যু রেকর্ড, জন্মনিবন্ধন, ওয়ারেশকায়েম সনদসহ বেশ কিছু অতিগুরুত্বপূর্ণ সেবাদানের ফলে ইউনিয়ন পরিষদ দিনদিন “ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টারে” পরিণত হচ্ছে। শহর নয়, গ্রামকে ঘিরেই একদিন পুরো দেশ আবর্তিত হবে বলে মনে করেন ইউপি চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান।
আরও পড়ুন: মহেশপুরে প্রধান শিক্ষকের মারপিটে রক্তাক্ত ছাত্র