তদন্ত হলে বেরিয়ে পড়তে পারে থলের বিড়াল
সব অভিযোগ অস্বীকার উপ-পরিচালকের
সুনীল ঘোষ: বসন্তে ফোটেনি দৃষ্টিনন্দন ফুল। প্রকৃতি যেন ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ। অপরুপ সৌন্দর্য গেছে দূর-নির্বাসনে। রুক্ষ-শুস্ক মরামুখি চেহারার বৃক্ষ-বনরাজই জানান দিচ্ছে ভালো নেই তারা। হতাশার এই চিত্র খয়েরতলা হর্টিকালচার সেন্টারের। অনিয়ম-দুর্নীতি কেড়ে নিয়েছে গোটা উদ্যানের অপরুপ সৌন্দর্য। প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে উন্নতমানের চারা/কলম ও বীজ উৎপাদন এবং বিতরণের নামে কোটি কোটি টাকা লুটেপুটে খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকের ঘাম বিক্রির টাকা নিয়েও নয়-ছয় করার অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা।
হর্টিকালচার সেন্টারের অবস্থান যশোর শহরতলীর খয়েরতলায়। বিশাল আকৃতির এই প্রতিষ্ঠানটির জমির পরিমাণ ১৫.২৯ একর। প্রায় ৫০ বিঘা জমির এই প্রতিষ্ঠানে সরকারি বেতন-ভাতা ভোগ করছেন ১৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী। নিয়মিত ও অনিয়মত কর্মচারী রয়েছে আরও ৬ জন। এর বাইরে চাষাবাদ, ফল, ফুল, সবজি ও মসলাসহ শোভাবর্ধনকারী ফসল উৎপাদনে দৈনিক হাজিরায় কাজ করেন আরও শ্রমিক।
উপ-সহকারী (উদ্যান কর্মকর্তা) দীপঙ্কর দেবনাথ জানান, সেন্টারটিতে ১৪ প্রজাতির আমসহ ৪৪ প্রকারের চারা ও কলম রয়েছে। বিভিন্ন সময় চাষিদের প্রশিক্ষণ ও চারা বিতরণ করা হয়। বছরভর দেশি-বিদেশি উন্নত জাতের ফল-ফুল ও শোভাবর্ধনকারী বিভিন্ন প্রজাতির চারা ও কলম সরকার নির্ধারিত মূল্যে যে কেউ কিনতে পারেন।
তিনি আরও জানান, ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গত ৩ বছর ধরে উদ্যানে ফসল তথা ফল, সবজি, মসলা, ফুল ও শোভাবর্ধনকারী ফসলের চারা/কলমের বাম্পার উৎপাদন ও বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি এসবের একটি তালিকাও দেন। তবে হিসাব-নিকাশের কোন তথ্য দিতে পারেননি এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, স্যারের নির্দেশের বাইরে কিছুই বলার অনুমতি নেই।
দৈনিক হাজিরায় কাজ করা এক শ্রমিক নিয়ে যান উদ্যানে। গোটা উদ্যান ঘুরে মেলানো যায়নি তালিকার সাথে মাঠের চিত্র। ১৪ প্রজাতির আম চারা/কলমের মধ্যে দেখা গেছে ৬ প্রকারের। এরবাইরে অন্যান্য প্রজাতির কিছু মাতৃ গাছ নজরে পড়ে। তবে তার সংখ্যাও কম। তালিকায় যেসব চারা ও কলমের কথা উল্লেখ রয়েছে মাঠে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ওই শ্রমিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমতা আমতা করেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘স্যারেরা বলতে পারবেন। মাঠ ঘুরে ফিরে দেখা যায় উদ্যান কর্মকর্তারা উধাও। এ সময় উপ-পরিচালকের দপ্তরে গিয়ে দেখা যায় একটি শিশুকে নিয়ে খেলছেন এক নারী। তিনি বলেন, সবাই খাবার খেতে বাইরে গেছেন। বড় স্যার ফেয়ারওয়েলে আছেন। ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যাবে।
চারা-কলমসহ গোটা উদ্যানজুড়ে রুক্ষ-শুস্ক ও রুগ্ন রুপ প্রসঙ্গে উপ-সহকারী দীপঙ্কর দেবনাথ বলেন-ভাল গাছ বিতরণ ও বিক্রি হয়ে গেছে। তাছাড়া মাঠজুড়ে প্রায় ৫০০ প্রাচীন নারকেল গাছ রয়েছে। এ কারণে চারা-কলমে রুগ্ন রুপ দেখা যাচ্ছে। তিনি নারকেল বাগানকে দোষাররোপ করেন।
উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহার দপ্তরে বসে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান-রোববার আসেন, আমি অনুষ্ঠানে আছি। ঘটনাটি ২৭ জানুয়ারির।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখা মেলে উপ-সহকারী সাইদুর রহমানের সাথে। তিনি চাষিদের প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ ও বাগান তৈরির দায়িত্ব পালন করেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে কতজন কৃষক ও নার্সারী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং ব্যয় হয়েছে কত ? তিনি সদুত্তর না দিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে অফিস ত্যাগ করেন।
গত সপ্তাহে সেন্টারে দেখা মেলে উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহার সাথে। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, খাতাপত্রে সবকিছু ঠিক আছে।
প্রতিষ্ঠানটি থেকে বছরে সরকারের রাজস্ব আয় কত জানতে চাইলে তিনি বলেন-এটি মূলত সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী কয়েকজন কৃষকের নাম-ঠিকানা জানতে চাওয়া হলে তিনি সাইদুর রহমানকে বলেন, গত পরশু যে প্রশিক্ষণটি হয়েছে, তাদের মধ্যে দু’একজনের নাম ঠিকানা দেন।
সাইদুর রহমান বলেন, এ মুহূর্তে দেয়া সম্ভব না। তিনি বলেন, পরে যোগাযোগ করে তথ্য দিয়ে আসবো। কিন্তু পক্ষকাল পার হলেও মেলেনি তার দেখা।
প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা যায়, ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ অর্থ বছর পর্যন্ত হর্টিকালচার সেন্টার, খয়েরতলা যশোর থেকে ৮ হাজার ৬৫৭ জন কৃষক ও নার্সারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১২৮০ জন পুরুষ ও ৩৭ জন নারী কৃষক নিয়েছেন। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেখানো হয়েছে ৯৬৭ জন পুরুষ ও ২৩৩ জন নারী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৪৪৭ জন পুরুষ ও ২১৩ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ১৮১৮ জন পুরুষ ও ৮৮২ জন মহিলা কৃষককে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৬৩৯ জন পুরুষ, ৩৫১ জন মহিলা কৃষক ও ১২ জন নার্সারী প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
অভিযোগে জানা যায়, গত ৭ বছরে প্রশিক্ষণ খাতে সরকারের ১০ কোটিরও বেশি টাকা তসরুপ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা, তাদে;র সম্মানী ও আপ্যায়ন খরচ বেশি দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর সরকারি অর্থ লোপাট করেছে-এমন অভিযোগ বিভিন্ন সূত্রের। সূত্রের দাবি, চারা-কলম, ফল-ফুল এবং ফসলসহ যা কিছু উৎপাদন, বিতরণ ও বিক্রি করা হয়, তার সিংহভাগ অর্থ পকেটস্থ করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিষ্ঠানটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে দাবি করে স্থানীয়রা জানান, কিতাবে আছে-গোয়ালে নেই অবস্থা বিরাজ করছে গোটা উদ্যানে।
শনিবার সাইদুর রহমানের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়।
উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, আমি এসেছি ৫-৬ মাস। এ সময়ে কোন রকমের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি। তবে আগে কি হয়েছে তা আমার জানা নেই।
তিনি সংযোগ বিছিন্ন করতেই রিং ব্যাক করেন উপ-সহকারী সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক না।
এদিকে এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া কোন কৃষকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হর্টিকালচার কেন্দ্র, খয়েরতলা যশোরের ভিশন ও মিশন
ভিশন : উদ্যান ফসলের টেকসই ও লাভজনক উৎপাদন।
মিশন : টেকসই ও লাভজনক উদ্যান ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য দক্ষ, ফলপ্রসু, বিকেন্দ্রিকৃত, এলাকা নির্ভর, চাহিদাভিত্তিক এবং সমন্বিত কৃষি সম্প্রসারণ সেবা প্রদানের মাধ্যমে সকল শ্রেণির কৃষকের প্রযুক্তি জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ।
ভিশন ও মিশন প্রসঙ্গে কর্তৃপক্ষের দাবি-গত ৩ বছরে উদ্যান ফসল তথা ফল, সবজি, মসলা, ফুল ও শোভাবর্ধনকারী ফসলের চারা/কলমের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। তবে এই দাবির সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কৃষি বিভাগের একাধিক সূত্রের দাবি, উপরিমহল তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল।