মিলার সিণ্ডিকেটকে দুষছেন খুচরা চাল বিক্রেতারা
বস্তায় লেখা থাকলেও দেয়া হয় ভিন্ন জাতের চাল
সুনীল ঘোষ: বস্তার গায়ে লেখা আছে বাসমতি। অথচ ভিতরে দেয়া আছে ভিন্ন জাতের চাল। শুধু নাম লিখেই ঠকানো হচ্ছে ক্রেতাকে। যশোরের বাজারে এ প্রতারণার জাল সর্বত্র। আর এভাবে ভোক্তাকে প্রতারিত করা হচ্ছে বছরের পর বছর। বাসমতির নামে খাওয়ানো হচ্ছে ব্রি-৬৩ জাতের চাল। ব্রি-৬৩ ছাড়াও আরও কিছু ধানের চাল রয়েছে, যা দেখতে অনেকটা বাসমতি বা বাংলামতির মতোই। কিন্তু ভাতে নেই সুগন্ধি। স্বাদেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। অটো রাইচ মিল মালিক সি-িকেট প্রতারণার মাধ্যমে লুটে নিচ্ছে অধিক মুনাফা।
যশোর শহরের বড়বাজারের হাটচান্নি খুচরা ও পাইকারী চাল বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে হরেক রকমের চাল আসে মুড়লীর মোড় অটোরাইচ মিল এরিস্ট ফুড, পদ্মবিলার ইলা অটো (যশোর ট্রেডিং নামে পরিচিত), শার্শার উলশীর পানবুড়ি অটো, নাভারণের গোল্ডেন অটো, চৌগাছার সলুয়া বাজারের জেস কোম্পানি ও পুড়াবাজার অটো, ফুলতলার শেখ অটো (জয়তুন অটো নামে পরিচিত), যশোরের বাঘারপাড়া, মাগুরার আড়পাড়া, সীমাখালী থেকেও নানা নামের অটো রাইচ মিল থেকে।
এরবাইরে কুষ্টিয়া ও দিনজাপুর থেকেও যশোরের বড় ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করেন। আকাশ ছোঁয়া দামের প্যাকেট চালের সরবরাহ করে আকিজ ও এসিআই কোম্পানি। তাদের হিসাবমতে, কুষ্টিয়াতেই অটোরাইচ মিল রয়েছে ৫৫টি। এরবাইরে যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরাসহ আশপাশের জেলা-উপজেলায় অন্তত ১৫/২০টি অটোরাইচ মিল রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাটচান্নির একাধিক চাল বিক্রেতা জানান, মিলারচক্রের কাছে ভোক্তা ও আমরা জিম্মি।
প্রতারণার কথা স্বীকার করে দৈনিক কল্যাণকে জানান, বছরখানেক ধরে যশোরের বাজারে বাসমতি বা বাংলামতির সুগন্ধি চালের সরবরাহ নেই। কৃষকের ধান এখন মিলারচক্রের গুদামে। তারা যেমন চাল নিয়ে প্রতারণা করছে, তেমনি সরবরাহ কমিয়ে চড়া বাজার দর ধরে রাখছে। প্রশাসনের নজর জায়গা মতো পড়ছে না বলেও অভিযোগ এসব চাল বিক্রেতার।
তারা আরও বলেন, কুষ্টিয়ার ৫৫টি ও যশোরাঞ্চলের ১৮/২০টিসহ অনন্ত ৭৫টি অটোরাইস মিল মালিক সুগন্ধি চাল পাঠাচ্ছে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে যেসব শহরে ভিআইপি প্রকৃতির লোকের বসবাস, সেখানে বেশি দামে সুগন্ধি চাল সরবরাহ করছে। সুগন্ধি চালের কেজি গত এক বছরধরে সর্বনি¤েœ ৮০ টাকা কেজি দরে পৌঁছাচ্ছে ভোক্তার হাতে। বৈধ-অবৈধ পথেও সুগন্ধির চাল চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে ভারত ও পাকিস্তান ঘুরে আরব আমিরাতেও। সেখানে প্রতিকেজি বাসমতি ও বাংলামতির সুগন্ধির চাল বিক্রি হচ্ছে দেড়শ’ থেকে দু’শ টাকায়। এতো দামে চাল কেনা মানুষের সংখ্যা যশোরে একদমই কম, বলেছেন তারা। যশোরের বাজারে ব্রি-৬৩ জাতের চাল বাসমতির নামে ৬৭ টাকা থেকে শুরু করে ৭০ টাকা পর্যন্ত কেজি বিক্রি হচ্ছে।
বারোবাজার বেলাট গ্রামের কৃষক আব্দুল জানান, বাসমতি ছাড়াও কাটারিভোগ, মদনভোগ, কালিজিরা, চিনিকানাই, বাদশাভোগ ও বাসফুলসহ কয়েকটি জাতের ধান চাষ আমন মৌসুমে হয়। এসব ধানের চাষ কমে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, এসব ধানের চালের ভাত সুগন্ধি হয়। তুলসী আতপ, তুলসীমণি, বিআর-৫,ব্রি-৩৪, ব্রি-৩৭ ধানের চালের ভাতে সুগন্ধি পাওয়া যায়। তবে এর অধিকাংশ ধানের চাষবাদ নেই বললেই চলে। কপাল থেকে অনেক কিছুই উঠে গেছে বলেও মন্তব্য করেন এই কৃষক।
সাড়াপোলের স্কুল শিক্ষিকা নন্দিতা রানী বলেন, বাসমতি চাল কিনছি কিন্তু ভাত হচ্ছে খুদির ভাতের মতো। স্বাদ নেই, গন্ধ নেই। তিনি বলেন, ভাতে স্বাদ না পেয়ে চাল ফেরত পাঠিয়েছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস মুঠোফোনে বলেন, প্রতারণার বিষয়টি জানা নেই। তবে চাল কেটে সরু করার বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট, সবাই জানেন। চালের উপরি অংশ কেটে ফেলার কারণে স্বাদ-সুগন্ধ কিছুই থাকে না। তিনি বলেন, বাসমতির নতুন ভার্সন বাংলামতি। বাংলাদেশ কৃষিবিভাগ ব্রি-৫২ নামে যে ধাণের উদ্ভাবন করেছে তার নামই বাংলামতি। এ চালের ভাতে হালকা সুগন্ধি পাওয়া যায়।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পুষ্টিবিদ শিরিন নিগার জানান, চাল কেটে সরু করার কারণে ভিটামিন থাকছে না। শক্তি-পুষ্টিহীন চাল সর্বত্রে ছড়িয়ে পড়েছে।