অপ্রতিরোধ্য জাকির ও আনারুল সিন্ডিকেট
সদর ফাঁড়ির ‘চোখ ফাঁকি’ দিয়ে ব্যবসা
‘মাসোহার পায়’ মাদক নিয়ন্ত্রণের এক কর্তা
এর আগে মদ পানে মারা যান ১৯ জন
লাবুয়াল হক রিপন
যশোর শহরের বাবুবাজার-ঝালাইপট্টি ও মাড়ুয়া মন্দির সংলগ্ন পতিতাপল্লী ঘিরে শক্তিশালী একটি মাদক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা বেপরোয়াভাবে চালিয়ে যাচ্ছে মাদকের কারবার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সাবেক মেম্বার জাকির ও আনারুলের নেতৃত্বে ওই সিন্ডিকেটের ডজন খানেক কারবারী মাদক বেচাকেনা করছে। এর আগে এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছ থেকে ভেজাল মদ খেয়ে প্রাণ গেছে অনেকের। সংবাদপত্রে গত চার বছরে যশোরে অন্তত ১৯ জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ হয়েছে।
নিষিদ্ধ পল্লীর ওই দু’টি এলাকায় সদর ফাঁড়ি পুলিশ নিয়মিত টহল দিলেও তাদের ‘চোখ ফাঁকি’ দিয়ে চক্রটি মদের কারবার করছে ধারণা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যশোর সদর ক-সার্কেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লায়েকুজ্জামান সেখান থেকে মাসোহারা পাওয়ায় নির্বিঘ্নে বেচাকেনা করে যাচ্ছে চক্রটি।
সূত্র মতে, এই এলাকায় মাদক সিন্ডিকেটের হোতা সাবেক ইউপি মেম্বার জাকির হোসেন। এছাড়া তার সহযোগী রয়েছেন রাসেল, আনারুল, মন্টু, ছোট মহসিন, বাবু, সাজু ও টাকুয়া। অত্যন্ত সুকৌশলে মাদক বিক্রি করছে তারা। তাদের নামে মাদকের একাধিক মামলাও রয়েছে।
এ চক্রের জাকির মেম্বার ও আনারুল ঝালাইপট্টি-বাবুবাজার পতিতালয় এলাকায় অবস্থান করেন। বাবুবাজার ২ নম্বর গলির এক যৌনকর্মীকে বিয়ের সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে বাবুবাজার এলাকায় বসবাস করছে আনারুল। সেই সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ মাদকের কারবার। আনারুল যৌনকর্মীর ওই ঘরকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণভাবে মাদকের ব্যবসা করতেন। এক সময় যশোরের পত্রপত্রিকায় তার এই ব্যবসার গোমর ফাঁস হলে তিনি সাতক্ষীরায় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে গা ঢাকা দেন। কিছুদিন সেখানে অবস্থানের পর আবারো পতিতালয় এলাকায় ফিরে এসে নতুন কৌশলে শুরু করেন মাদকের ব্যবসা। সিদ্ধ ডিম বিক্রির আড়ালে তিনি প্রতিদিন পতিতালয়ের সামনে ও আশপাশে মাদক বিক্রি করতেন। কিন্তু ইদানিং কৌশল বদল করেছেন। শরীরে মদের বোতল আর হাতে পানির বোতল রেখে খরিদ্দারদের কাছে রান্না খাবারের সাথে সরবরাহ করছেন। মূলত মদ খাওয়ার জন্য মুরগির লটপটি সরবরাহ করে থাকেন। তার এই বাংলা মদ, ইয়াবা ও গাঁজা আশপাশে তার অনুসারীদের প্রতিষ্ঠানে ও স্বপ্নপুরী হোটেলের পিছনে কার্নিসের উপরে রেখে খরিদ্দারদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
সিন্ডিকেটের আরেক হোতা সাবেক মেম্বার জাকির হোসেন পতিতালয়ে একটি বিয়ে করে দীর্ঘদিন ধরে তিনিও একই কায়দায় মাদকের কারবার করে আসছেন। ২০২০ সালের মাদকের ছোবলে একেক করে আসক্তের মৃত্যুর পর পুলিশের মামলার আসামি হয়ে তিনিও গা-ঢাকা দেন। সম্প্রতি আইনশৃক্সলা বাহিনীর গাছাড়া ভাবে আবারও পূর্বের মত কারবার শুরু করেছেন। তবে তার সাথে রয়েছেন অন্তত ডজন খানেক সহযোগী।
সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য রাসেল (আনারুলের খুবই আস্থাভাজন) তাড়িখানা গলিতে একটি টোং ঘরে মদ রেখে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খরিদ্দারের সাথে যোগাযোগ ও সরবরাহ করে থাকেন। আবার এখানে আসা খরিদ্দারদের কাছেও বিক্রি করেন। এছাড়াও রাসেল তার বাসস্থান বিরামপুর এলাকায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন জনের কাছে ভ্রাম্যমাণভাবে মাদক (বাংলা মদ, ইয়াবা ও গাঁজা) সরবরাহ করে থাকেন।
আরেক সদস্য ছোট মহসীন। আগে একাকী মদ, গাঁজা ও ইয়াবার ব্যবসা করতেন। এখন সংঘবদ্ধভাবে মাদকের কারবার করছেন। সুযোগ বুঝে পতিতালয়ে আসা লোকজনের কাছ থেকেও দালালির নামে প্রতারণা করে থাকেন ছোট মহাসিন। প্রতারণার শিকার হলেও লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে মুখ খোলেন না। এখন তিনি স্বপ্নপূরি হোটেলেই থাকেন এবং তাড়িখানা গলিতে মাদকের কারবার করেন।
সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য টাকুয়া ঝালাইপট্টির সামনে বৈদ্যুতিক খাম্বার পাশে কামারের দোকানের পিছনে বসে বিভিন্ন কায়দায় মাদক সরবরাহ করে থাকেন।
এই সিন্ডিকেটটি মাড়ুয়া মন্দির পতিতালয়ের সামনের বাংলা মদের ডিলারের কর্মচারী গৌর এর কাছ থেকে মদ কিনে আনে। এরপর প্রয়োজন মতো পানির সাথে স্পিরিট ও নেশার ট্যাবলেট মিশিয়ে খরিদ্দারদের কাছে সরবরাহ করে থাকেন। ইয়াবা ও গাঁজা ভ্রাম্যমাণভাবে বিক্রি করে থাকেন।
এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাবুবাজার-ঝালাইপট্টি এলাকায় এই মাদক বিক্রেতাদের কারণে সবসময় পরিস্থিতি থাকে অস্বাভাবিক। মাদক সেবন করে অনেকে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। প্রায় সময় এখানে হাতাহাতি-মারামারির ঘটনা ঘটে। যৌনকর্মীরাও তাদের ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকেন। কিন্তু ভয়ে মুখ খোলার সাহস নেই তাদের। গত ২৭ জুন দুপুর ১টার দিকে মদপান করে দুইজন অস্বাভাবিক অবস্থায় একজন অন্যজনকে চাকু মারতে যায়। এসময় ভয়ে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে মদ বিক্রেতা সিন্ডিকেটের হোতা জাকির হোসেন বলেন, বোঝেন তো, প্রশাসনের সাথে কথা না বলে তো আর এই ব্যবসা করা যায় না। প্রশাসন রাজি ছিল না তাই গত চার বছর কোন ব্যবসা করতে পারিনি। এখন রাজি হয়েছে বলেই ব্যবসা শুরু করেছি।
যশোর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় নেই, বাবুবাজার এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। যেকোন সময় আমাদের অভিযান চলবে।
এ ব্যাপারে যশোর সদর ফাঁড়ির ইনচার্জ ফকির পান্নু মিয়া বলেন, এখানে অবৈধ মদের কারবার চলে তা আমার জানা নেই। তবে আমি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছি। এরকম অবস্থা হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
এই ব্যাপারে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক সদর ক-সার্কেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লায়েকুজ্জামান বলেছেন, অবৈধ মদ বিক্রেতাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য চেষ্টা চলছে।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আসলাম হোসেন জানিয়েছেন, বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে অবৈধ কারবারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।