নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উর্ধ্বতন হিসাব সহকারী মহাসিন আলীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চাকরি জীবনের ১৭ বছর (মাঝে এক বছর বাদে) তিনি একই অফিসে দায়িত্ব পালনকালে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। তিনি আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগ বাণিজ্য এবং বেনামি ঠিকাদারী ব্যবসার মাধ্যমে হয়েছেন বিপুল অর্থ ও সম্পত্তির মালিক। শ্রমিক লীগ যশোর জেলা শাখার নেতা হওয়ায় বিগত সময়ে তার বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একবার ঘুষকা-ে কেবল ‘তিরস্কার’ করেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এসব ঘটনায় পাউবোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
দুদকে অভিযোগ ও শুনানির প্রক্রিয়া : মহাসিন আলীর অনিয়মের তদন্ত চেয়ে আউটসোর্সিং কর্মচারী রাজু আহমেদ ও চাকরিচ্যুত কর্মচারী দিপংকর দাস গত ৯ অক্টোবর পাউবোর মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। একই সাথে, ২৮ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যশোর জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক বরাবরও লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। দুদকে করা অভিযোগের ভিত্তিতে আজ রোববার (২৬ অক্টোবর) তার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। দুদকের সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. সালাউদ্দিন জানিয়েছেন, গণগুনানিতে ভুক্তভোগীদের কথা শোনা হবে।
নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ : অভিযোগ অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে যশোর পাউবোতে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পদে ৩১ জন জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। উর্ধ্বতন হিসাব সহকারী মহাসিন আলী মেহেরপুরের ‘জোহা এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে টেন্ডার জমা দেন। লেনাদেনার সুবিধার্থে তিনি ঝিনাইদহের আবু সাইদ নামে একজনকে সঙ্গে দেন।
সূত্রের খবর, পূর্ব থেকে কর্মরত ৩১ জন কর্মচারীর মধ্যে ৭ জন ঘুষ দিতে রাজি না হওয়ায়, তিন বছর ধরে কাজ করা সত্ত্বেও তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ৭ জনের প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। টাকা দেওয়া নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় মুকুল হোসেন ও মাহফুজুর বাহমান নামে দুজনকে পরিবর্তন করে কবির ও খলিদ নামে দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ টেন্ডার ডকুমেন্টসে কবির ও খালিদের কোনো সিভি বা বায়োডাটা জমা দেওয়া ছিল না। এছাড়া, হোজাইফা নামে একজনের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি এবং তার জাতীয় পরিচয়পত্রও নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিয়োগ বাণিজ্যের বাইরে ক্ষমতা দেখিয়ে মহাসিন নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত আবু অয়ন নামে এক কর্মচারীকে এক মাসের ছুটিও দিয়েছেন, যা নির্বাহী প্রকৌশলী বা উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর এখতিয়ারভুক্ত।
বেনামি ঠিকাদারী ও অবৈধ বিত্ত : মহাসিন আলীর অনিয়ম শুধু নিয়োগ বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ না। ২০২১-২২ অর্থবছরেও আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগে তিনি বেনামে ঠিকাদার ছিলেন এবং সে সময়ও প্রতিজনের কাজ থেকে দুই-তিন লাখ টাকা করে দিয়েছিলেন। যশোর শহরের কদমতলার বাসিন্দা হাফিজুর রহমান জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরের আউটসোর্সিং জলবল নিয়োগে মহাসিন আলী তারা শ্যালককে তাদের সঙ্গে যুক্ত করে বেনামে ঠিকাদারী করেন। বর্তমানে চৌগাছার ধুলিয়ানিতে চলমান কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (২য় পর্যায়) প্রকল্পের সৌন্দর্য বর্ধন কাজেরও পার্টনার তিনি।
আউটসোর্সিং নিয়োগ বাণিজ্য ও ঠিকাদারী ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থ দিয়ে মহাসিন আলী যশোর শহর ও শহরতলীতে আত্মীয়-স্বজন ও পিতা-মাতার নামে এবং নিজ গ্রামে অনেক জমাজমি ক্রয় করেছেন। একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও তিনি দামি সুজুকি মোটরসাইকেল ও আইফোন ব্যবহার করে বিলাসী জীবনযাপন করেন।
আউটসোর্সিং কর্মচারী রাজু আহমেদ অভিযোগ করেন, মহাসিন তাকে সরকারি চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ‘মিষ্টি খেতে’ ২ লাখ টাকা দিয়েছিলেন, অথচ তাকে দেওয়া হয় আউটসোর্সিংয়ের চাকরি।
রাজনৈতিক প্রভাব ও বদলি না হওয়া : মহাসিন আলী বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড শ্রমিক-কর্মচারী লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদক এবং শ্রমিক লীগ যশোর জেলার শিক্ষা ও সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক। সরকারি চাকরিজীবীদের তিন বছর পর বদলির নিয়ম থাকলেও, তিনি প্রায় ১৭ বছর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একই স্থানে থেকে দুর্নীতি ও ঠিকাদারী ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হেনস্তার অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি স্থানীয় এক বিএনপি নেতার সঙ্গে সখ্যতা করে তিনি সব অপকর্ম থেকে পার পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মহাসিন আলী গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে রাজি হননি। তবে, আজ ২৬ অক্টোবর দুদকের গণ শুনানি হবে। সেখানে মহাসিন আলীর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা অভিযোগের প্রমাণ দিবেন বলে জানিয়েছেন।

 
									 
					