নিজস্ব প্রতিবেদক
উৎসব হচ্ছে সামষ্টিগত আনন্দের প্রকাশের বাহন। আর এই উৎসব যদি হয় একটি জাতির সংগ্রাম-প্রতিবাদের অনুষঙ্গ তাহলে আর কথাই নেই। সেই উৎসবে থাকে না কোনো ভেদাভেদ, থাকে না কোনো ধর্ম-বর্ণ কিংবা গোত্র বিভাজন। ফলে তা হয়ে যায় সর্বজনীন, হয় সবার। তেমনি একটি উৎসব আমাদের বাংলা নতুন বছর বরণের দিন পহেলা বৈশাখ। আজ সেই পহেলা বৈশাখ। স্বাগত নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩০।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা/রসের আবেশরাশি/শুষ্ক করি দাও আসি/আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ/মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক। এভাবেই বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানায় বাঙালি।
আজ বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হয়েছে নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩০। পহেলা বৈশাখ আমাদের সব সংকীর্ণতা, কুপমণ্ডুকতা পরিহার করে উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভেতরের সব ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।
শুধু বাঙালিরই নয়, এ দেশের চাকমা মারমা তংচঙ্গাসহ সব পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠী এবং সমতলের আদিবাসীরাও এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেন নতুন বছরকে। এই উৎসব বাংলাদেশের সব ধর্মের সব জাতির মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলে। বাংলাদেশি সব নাগরিকদের এক সুতোয় বেঁধে ফেলার এমন উৎসব আর নেই। তাই বাংলা বর্ষবরণ উৎসব সার্বজনীন উৎসবে রূপ নেয়। যশোরসহ দেশজুড়ে থাকবে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। দিনটি সরকারি ছুটির দিন।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সব সরকারি-বেসরকারি টিভি, বাংলাদেশ বেতার, এফএম ও কমিউনিটি রেডিও বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং বাংলা নববর্ষের ওপর বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।
সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ৯২৩ হিজরি মোতাবেক ১৫৫৬ সালে। ২৯ বছর রাজত্ব করার পর তিনি পঞ্জিকা ও বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। হিজরি সন ও সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরকে যুক্ত করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়।
বলা হয়ে থাকে যে, ফসল কাটার মৌসুমে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এই সন চালু করা হয়েছিল। সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা মাসের নামগুলো নক্ষত্রের নাম থেকে নিয়ে সৌর মাসের দিন মিলিয়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এ ব্যাপারে ১৫৮৫ সালের ১০ মার্চ সম্রাটের নির্দেশনামা জারি হয়। তবে এর কার্যকারিতা দেখানো হয় ১৫৫৬ সালের ১১ মার্চ থেকে। কারণ ওই দিনটি ছিল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে বসার তারিখ। সেই থেকে বাংলা বর্ষপঞ্জির সূচনা হয়।
বাংলা নববর্ষের উৎসব আছে বলেই বাঙালির পরাজয় নেই। জাগরণের ঘণ্টাধ্বনি বাজায় এই উৎসব। মানুষ জড়ো হয় আপন নিয়মে। এই উৎসব শহরের ইট-কাঠ থেকে গ্রামের মেঠোপথ পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য অর্থে বলা যায়, এই উৎসব বয়ে এনেছে শস্যদানা। জলবতী মেঘ। রুপালি ইলিশ। বিনয় বাঁশির ঢোল। এখন এর সবটুকু শহরে প্রতিটি মানুষের প্রাণের স্পন্দন। নন্দিত হয় পুরো দেশ।
চারুপীঠের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয় ১৯৮৫ সালে যশোরে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাহবুব জামাল শামীম দুই সহপাঠীকে নিয়ে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন চারুপীঠ। এই প্রতিষ্ঠানই মঙ্গল শোভাযাত্রার সূতিকাগার। এর চার বছর পরই ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়, যা পরে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। এবারে নববর্ষে শোভাযাত্রার নৌকা, দোয়েল, কচ্ছপ, বড় আকৃতির সাপ, কুমির, বাঘ, পুতুলসহ নানা রঙের মুখোশ শোভা পাবে। বরাবরের মত পৌর উদ্যানে সকাল ৭টা ১ মিনিটে উদীচী যশোরের আয়োজনে হবে প্রায় আড়াই ঘণ্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব জানান, উদীচী হত্যাকাণ্ডের দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও বিচার না হওয়ায় এবারের নববর্ষ উৎসব স্লোগান করা হয়েছে-‘বৈশাখের এই তীব্র দহনকাল-ছিন্ন করুক বিচারহীনতার জাল’। স্লোগানের সাথে মিল রেখে আমন্ত্রণ পত্রে ব্যবহার করা হয়েছে পোস্টার। সুরবিতান সংগীত একাডেমি যশোরের উদ্যোগে সকাল সাড়ে ছয়টায় ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দানের শতাব্দী বটমূলের রওশন আলী মঞ্চে ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’ স্লোগানকে সামনে রেখে নববর্ষকে আহ্বান জানানো হবে। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বিশ্বাস জানান, ‘প্রতিবছরের মত এবারও ভিন্ন আঙ্গিকে বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানো হবে; পুনশ্চ যশোর নববর্ষের প্রথম দিন সকাল ৬টা ৩১ মিনিটে মুসলিম একাডেমি প্রাঙ্গণে করবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পান্না দে জানান, সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুকুমার দাস হঠাৎ করেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তার এই হঠাৎ প্রণয়ে কারোও কোন উৎসব করতে ইচ্ছা নাই। তার পরেও আমরা সুকুমার দাসের স্মরণে স্মৃতিতে উৎসর্গ করে ভারাক্লান্ত মন দিয়ে ছোট পরিসরে হলেও নববর্ষের অনুষ্ঠান চলবে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, ‘সুকুমার দাস ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক পথিকৃত। যশোরে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার এই অকাল চলে যাওয়া যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সেই শোককে শক্তিতে রুপান্তিত করতে এবারের সকল পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হবে সুকুমার দাসকে উৎসর্গ ও স্মৃতিতে। প্রতিটি সংগঠনই সুকুদার দাসের স্মৃতি ব্যানার নিয়ে এবারের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান করবে।
