আবদুল কাদের: যশোর শহরের বেজপাড়া মেইন রোডের একটি চা-দোকানে ভরদুপুরে রুটি-কলা খাচ্ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। দুপুরে ভাত না খেয়ে রুটি-কলা কেন খাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন সাধারণ রেস্তোরাগুলোতে এক বেলা সবজি, ডাল ও ভাত খেতেও ৮০ টাকা লেগে যায়। সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় তিনি দুপুরে রুটি-কলা খেয়ে কাটানো শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, গত জানুয়ারি মাসে তার বাসাভাড়া ৫০০ টাকা বেড়েছে। সন্তানের স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য দিনে রিকশাভাড়া লাগত ১৫ টাকা করে ৩০ টাকা। এখন লাগে ৪০ টাকা। চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ সব পণ্যের দামই বাড়তি। কোম্পানির কাজে যাওয়া-আসা করতেও ব্যয় বেশি হচ্ছে। কিন্তু তার আয় দুই বছর আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে। সংসার চালাতে এখন প্রতি মাসেই অন্যেও কাছ থেকে ধার করে চলতে হচ্ছে।
শহরের লোন অফিস পাড়ার বাসিন্দা রোকসানা আক্তারের স্বামী মারা গেছেন দুই বছর আগে। এখন তিনি ভাড়া বাড়িতে থেকে দুই সন্তানকে লালন পালন করছেন। কাজ করেন একটি কাপড়ের দোকানে। মাসে আয় আড়াই হাজার টাকা। তিনি বলেন, এই স্বল্প আয় দিয়ে বর্তমান বাজারে টিকে থাকা যায়না। যেকারণে মাসে অনেক দিন এক বেলা না খেয়ে থাকি।
ওই দু’জন মানুষের মতো সাধারণ মানুষের সংসারে ব্যয়ের বড় খাত খাদ্য, ঘরকন্নার উপকরণ কেনা, বাসাভাড়া ও সেবার বিল, সন্তানদের পড়াশোনা এবং পরিবহন। দেশে এই চারটি খাতেই একসঙ্গে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম অবস্থা মানুষের।
বাজারে এখন তেল ও চালের দাম চড়া। সাম্প্রতিককালে ডাল ও চিনির দাম বেড়েছে ব্যাপকভাবে। বেড়েছে সাবান, টুথপেস্ট, প্রসাধন, টিস্যুসহ সংসারে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম। করোনার কারণে গত বছর না বাড়ালেও চলতি বছর বাড়ির মালিকেরা বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের বেতন ও খাতা-কলমের দামও বাড়তি।
নজরুল ইসলাম নিজেই যেহেতু খাদ্যপণ্য সরবরাহের কাজ করেন, সেহেতু জানেন বাজারের পরিস্থিতি কী। তিনি বলেন, সীমিত আয়ের মানুষ খুব কষ্টে আছে। ধনীদের কথা আলাদা।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওই দিনের বাজারদরের তালিকা ও শুক্রবারের তালিকা ধরে তুলনামূলক বিশ্লে¬ষণ করে দেখা যায়, মোটা চালের দাম ১৫, মোটা দানার মসুর ডাল ৭৭, খোলা সয়াবিন তেল ৬০, চিনি ৪৯ ও আটার দাম ২১ শতাংশ বেড়েছে।
শুধু ভোজ্যতেলের কথা ধরা যাক। মধ্যম আয়ের পাঁচজনের একটি পরিবারে গড়পড়তা ৫ লিটার সয়াবিন তেল লাগে। টিসিবির হিসাবে, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি পাঁচ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৪৬৫ থেকে ৫১০ টাকা, এখন তা ৭৪০ থেকে ৭৮০ টাকা। মানে হলো, শুধু সয়াবিন তেল কিনতে একটি পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ৫৬ শতাংশ।
কাঁচাবাজারে মাছ, মাংস ও সবজির দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। তবে বিগত এক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, ফার্মে উৎপাদিত মুরগির দাম বছরজুড়েই বেশি থাকছে। যেমন ব্রয়লার মুরগির দাম এখন বছরের বেশির ভাগ সময় প্রতি কেজি ১৫০ টাকার বেশি থাকে। করোনার আগেও এই দর ১৩০ টাকার আশপাশে থাকত। বিক্রেতাদের দাবি, মুরগির বাচ্চা, খাবারের দাম ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই আর আগের দামে ফেরার আশা কম।
সীমিত আয়ের পরিবার কালেভদ্রে এখন গরুর মাংস কিনতে পারে। এখন বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৫৮০ থেকে ৬২০ টাকা। তিন বছর আগে এই সময়ে ছিল ৫০০ টাকার নিচে। সবজির দামও চড়া।
শুধু মুদিদোকান ও কাঁচাবাজারের খাদ্যপণ্য নয়, বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও। শহরের বড় বাজার এলাকার মুদিদোকানের মালিক আশিষ দাস বলেন, চার মাস আগেও একটি কাপড়কাচা সাবানের দাম ছিল ১৮ টাকা। এখন দাম ২২ টাকা। মাঝারি আকারের সুগন্ধি সাবানের দাম ৩ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। ৪৫ টাকায় আধা কেজি গুড়া সাবান পাওয়া যেত। এখন তা ৫২ টাকা। দাঁত মাজার পেস্টের মাঝারি প্যাকের দাম ৩ টাকা বেড়ে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা হয়েছে। বেড়েছে টিস্যুর দামও।
শিক্ষা উপকরণের দাম কতটা বেড়েছে, তা তুলে ধরেন শহরের জামে মসজিদ এলাকার দোকানি মুকুল হাসান। তিনি বলেন, একটি খাতার দাম ২০ থেকে বেড়ে এখন ২৫ টাকা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেনসিলের দাম। ১০ টাকার একটি পেনসিলের দাম ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস সিলিন্ডার (১২ কেজি) ৮০০-৮২০ টাকা ছিল, তা এখন ১ হাজার ৪শ টাকা।
ব্যয়ের সব খাতে এই চাপ এমন একটা সময় পড়েছে, যখন করোনার কারণে দেশের মানুষের একটি অংশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। যশোর-খুলনা মহাসড়কের একটি টায়ারের দোকানের কর্মচারি ইমরান হাসান জানান, আমার মাসিক বেতন ৫ হাজার টাকা। এই টাকায় বাড়া বাসায় থেকে মা ও এক ভাইকে নিয়ে সংসার চালাতে হয়। গত জানুয়ারি মাসে তার বাসাভাড়া ৫০০ টাকা বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করা হয়েছে। বাজারের যা অবস্থা, তাতে দিনে ৫শ টাকা আয় না করতে পারলে টিকে থাকা যায় না।
যশোরের বাজারে সব নিত্যপণ্যের দাম চড়া। হঠাৎ করে গত কয়েকদিনে কেজিতে আলুর দাম বেড়েছে ৫ টাকা। চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, মরিচ পেঁয়াজ-রসুনের দাম বেড়েছে।
প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয় ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা। কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৪৫ টাকা ৫০ টাকা। ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে কাচা মরিচ। প্রতি কেজি নতুন রসুন বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা। ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাক কেজি বিক্রি হয় পুরাতন রসুন। ১শ’২০ টাকা কেজি বিক্রি হয় আমদানিকৃত রসুন।
প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা। ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা পিচ বিক্রি হয় বাধাকপি। ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা কেজি মুলা, ৪০ টাকা কেজি ফুলকপি। প্রতি কেজি বেগুন ৩০ টাকা, ৩০ টাকা কেজি কুমড়া। পটল ১শ’ টাকা থেকে ১শ’২০ টাকা, প্রতি কেজি পেঁপে ১৫ থেকে ২০ টাকা, ১শ’ টাকা কেজি বিক্রি হয় উচ্ছে। প্রতি কেজি মেটে আলু বিক্রি হয় ৫০ টাকা। ওলকপি ৩০ টাকা। কলা বিক্রি ৩০ টাকা, ৫০ টাকা কেজি কুশি। ৩০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে লাল ও সবুজ শাক।
তবে পণ্যের দাম যাতে বেশি না নেয় যশোর প্রশাসন এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
বাজার তদারকির বিষয়ে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সায়েমুজ্জামান বলেন, আমরা ইতিমধ্যে বাজার তদারকিতে নেমেছি। অনেক অসাধু ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। বাজারে যাতে কেউ বেশি দামে পন্য বিক্রি করতে না পারে সেজন্য আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যশোরের সহকারী পরিচালক ওয়ালিদ বিন হাবিব বাজারে সব ধরণের জিনিসের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে না পারে সেজন্য আমাদের তদারকি অব্যাহত আছে। ইতিমধ্যে আমরা জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ২০টি দোকানিকে জরিমানা করা হয়েছে। আসছে রমজানে আমাদের বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করা হবে।