নিজস্ব প্রতিবেদক
৫ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সাল। ভোররাতে আমাদের বাহিনী ঢুকে পড়ে রাজশাহীর হরিহরাপুর গ্রামে। পায়ে হেঁটে ৭-৮ মাইল ভেতরে ঢুকে সবাই একসাথে শ্লোগান দিই জয় বাংলা। সেই সঙ্গে ছুড়ি ফাঁকা গুলি। ওই দিনই নওগাঁর ফার্সিপাড়া ক্যাম্প আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয় আমাদের।
কনকনে শীতের রাত্রি। কিন্তু যুদ্ধের উত্তেজনায় ঠান্ডার লেশমাত্র অনুভূতি ছিল না। অন্ধকারের বুক চিরে জোনাকির আলো সঙ্গী করে উঁচু আখ ক্ষেতের আলপথ মাড়িয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা ফার্সিপাড়ায় পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প অভিমুখে। বাঁচি না বাঁচি পরোয়া নেই কারোর। কদমের পর চলছে কদম।
নির্দেশ মতো রাতে ফার্সি পাকবাহিনীর ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলি আমরা। চার ভাগে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পের চারপাশে অবস্থান নেই। ক্যাম্পের পূর্ব পাশে একটি পুকুর ছিল। কথিত এক রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের পথ দেখিয়ে আখ ক্ষেতের ভেতর দিয়ে ওই পুকুরের ধারে নিয়ে যায়। পুকুরের পাড়ে গিয়ে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত হই। একটা টিম ছিল সুইসাইড স্কোয়ার্ড। যার নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার পি এস সিংড়া।
আত্মঘাতি দল পুকুরের পূর্ব পাশে অবস্থান নেয়। পুকুরের পশ্চিম পাশে অবস্থান নেন ভারতীয় সেনা অফিসার ডি এস ধীলনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় টিম। তৃতীয় টিমের সদস্যরা কেরালার অফিসার আবুর নেতৃত্বে দক্ষিণ পাশে চলে যায়। যুদ্ধ পরিচালনায় ছিলেন ডি এস ধীলন।
ক্যাম্পে আক্রমণ শুরুর পর আমরা ভুল বুঝতে পারি আমাদের। ইনফরমার খবর দিয়েছিল ক্যাম্পটিতে একশর কিছু বেশি সংখ্যক আর্মি আছে। কিন্তু আমাদের তরফ থেকে গুলির পাল্টা জবাবে মুড়ি মুড়কির মতো শত শত গুলি যখন ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে থাকে; তখন বুঝতে পারি এখানে শত শত পাকিস্তানি আর্মি রয়েছে। আমাদের ১২০ জনের দলের পক্ষে তাদের প্রচুর সংখ্যা ও ভারি অস্ত্রের মুখে বেশি সময় টিকে থাকা সম্ভব না। ঠিক তখনই পুকুরের পশ্চিম দিক থেকে ট্রেসার বুলেট ছুঁড়ে ডি এস ধীলন এক নতুন সংকেত দিলেন। যার অর্থ এই ক্যাম্পে চূড়ান্ত রেইড করা যাবে না।
কৌশলগত কারণে আমরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছু হটতে থাকি। এরই মধ্যে আমাদের ৬ সহযোদ্ধা গুরুতর আহত হন। তাদের ফেলে রেখেই কোনো রকমে আমাদের সরে আসতে হয়। পরে জানতে পেরেছিলাম ওই ৬ বীরমুক্তিযোদ্ধাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পাকবাহিনী।
সহযোদ্ধাদের হারানোর সেই ক্ষত আজো বয়ে বেড়াই। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়; যখন ভাবি তাদের মৃত্যুর মুখে ফেলে নিজের জীবন বাঁচাতে স্বার্থপরের মতো কেনো চলে আসলাম।
২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম কলেজ) কলেজে আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় একাত্তরের যুদ্ধদিনের এমন সব স্মৃতিচারণ করেন বীরমুক্তিযোদ্ধা রুকুনউদ্দৌলাহ। সোমবার সকালে কলেজটির শিক্ষক মিলনায়তনে ছিল এই আয়োজন।
এতে সভাপতিত্ব করেন কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মদন কুমার সাহা। প্রধান অতিথি ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মর্জিনা আক্তার। সম্মানিত অতিথি হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন বীরমুক্তিযোদ্ধা রুকুনউদ্দৌলাহ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আবু বক্কর সিদ্দিকী। এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিল্লুর বারি ও সহযোগী অধ্যাপক মোমিন উদ্দিন। আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহাদাৎ হোসেন। গণহত্যা দিবসের এই স্মৃতিচারণ ও আলোচনা অনুষ্ঠানে কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।