-
চর্ম ও যৌন চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা
-
চিকিৎসকের বাণিজ্যিক মনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
-
মোড়কে বিদেশি ওষুধের তথ্য থাকলেও বারকোডে প্রবেশ করে মেলেনি
-
নির্দিষ্ট ফার্মেসি ছাড়া মেলে না, উপকারের চেয়ে ক্ষতির আংশকা বেশি
শাহারুল ইসলাম ফারদিন
জুয়েল হাসান পেশায় একজন ব্যাংকার। এলার্জি জাতীয় সমস্যা নিয়ে যশোরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নামকরা একজন চর্ম ও যৌন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তাকে ব্যবস্থাপত্রে ছয়টি ওষুধ, সাবান ও ক্রিম দেন। তিনি ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে গিয়ে পড়েন বিপাকে। তার এ ওষুধ নাকি হাতে গোনা দুই একটি বড় বড় ফার্মেসিতে ছাড়া পাওয়া যাবে না। তারপরও চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিদেশি ওষুধ, সাবান ও ক্রিম হওয়ায় দামও অনেক বেশি। বেশ কয়েক দোকান ঘুরে তার সত্যতা মেলে।
এমএম আলী রোডের জামান ফার্মেসি, হাসপাতাল মোড়ের ইউরি ড্রাগ হাউজ, প্যারামাউন্ডসহ কয়েক বড় বড় ফার্মেসিতে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিদেশি সাবান ও ক্রিম মিলছে। তবে তার দাম ১২শ থেকে ১৫শ টাকা। তিনি প্রায় দুই মাস এই ওষুধগুলো ব্যবহার করার পরও কোন উন্নতি হচ্ছিল না। পরবর্তীতে শনিবার তিনি লোখমুখে শুনে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের চর্ম ও যৌন বিভাগের চিকিৎসক গোলাম মোর্তুজার শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক আগের সবগুলো ওষুধ বাদ দিয়ে দেশি কয়েকটি ওষুধ ও ক্ষত স্থানে একটি মলম লাগাতে বলেন। যার দাম সব মিলিয়ে ৩শ টাকার মতো। আবার অধিকাংশ ফার্মেসিতেই তা মিলছে। জুয়েল হাসান বলেন, এর আগে ওষুধ প্রয়োগেও উপকার না পেয়ে মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।
জুয়েলের মতো অজস্র উদাহরণ রয়েছে যশোরে। অভিযোগ রয়েছে ডাক্তাররা তাদের প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় বিদেশি দামি ওষুধ যেমন লিখছেন তেমনি বেশি ওষুধও লিখছেন। এছাড়াও ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লাগামহীন প্রচার খরচ, বিশেষ করে নিজ নিজ ব্র্যান্ডের ওষুধ লেখাতে চিকিৎসকদের পেছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় ওষুধের দাম বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে। এদিকে তাদের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে নিয়মিত মাসোহারার লোভে অনেক চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন ‘মানহীন’ ও ‘অপ্রয়োজনীয়’ ওষুধ। ফলে সাধারণ মানুষ দুই দিক থেকেই প্রতারিত হচ্ছেন। বেশি দামে ওষুধ কিনছেন, কিন্তু পাচ্ছেন নিম্ন মানের চিকিৎসা ও ওষুধ।
সোমবার সকালে কথা হয় আরেক ভুক্তভোগী তাবাচ্ছুম আরজু সাথে। তিনি জানান, ঈদের আগে স্কিনের জন্য নামকরা একটি বেসরকারি ক্লিনিকের চর্ম, যৌন, এলার্জি বিশেষজ্ঞ ও ডার্মাটো সার্জন চিকিৎসকের চেম্বারে যান তিনি। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে বিদেশি ডার্মা সানস্কিনসহ দামি দামি চারটা ওষুধ সাজেস্ট করেন তাকে। রোববার সকালে ওই ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকানে গিয়ে জানতে পারেন নির্দিষ্ট কিছু দোকান ছাড়া এসব ওষুধ পাওয়া যাবে না। তিনি শহরের এমএম আলী রোডের জামান ফার্মেসিতে এসে জানতে পারেন, শুধু ডার্মা সানস্কিনের দামই ২২শ টাকা। সানস্কিন নিয়েই বাড়ি ফিরে যান তিনি। পরবর্তীতে তিনি স্বামী বিপুল মন্ডলসহ বাকি ওষুধ কিনতে যান শহরের হাসপাতাল মোড় এলাকার একটি দোকানে। একসপ্তাহের ওষুধের দাম জানতে চাইলে ১৮শ টাকা পড়বে বলে জানান দোকানি। দামি ওষুধ হওয়ায় তার স্বামী ওষুধের মোড়কে থাকা বারকোড স্ক্যান করে কোন তথ্য না মেলায় দোকানে থাকা বিক্রয় কর্মীর সাথে তর্কাতর্কি জুড়ে দেন। জানতে চাইলে তিনি জানান, এর আগেও বেশ কয়েকটি দোকানে তিনি গেছেন। চিকিৎসক বলছেন ফ্রাঞ্চ, জার্মানির ওষুধ নাকি এগুলো। এতো উন্নত দেশের ওষুধের মোড়কে থাকা বার কোডে কোন ইনফরমেশন থাকবে না, তা কিভাবে সম্ভব ? আবার সরকার অনুমদিত বিএসটিআইয়ের স্টিকার লাগানো রয়েছে। তিনি বলেন, এগুলো সব ইন্ডিয়ান ওষুধ। চোরাই পথে এনে বিএসটিআইয়ের ভুয়া স্টিকার ছাপিয়ে তা নিজেরাই লাগিয়ে নিয়েছে। চিকিৎসকরা সব জানেন, তারপরও দোকনদারদের যোগসাজে কমিশনের আশায় অপ্রয়োজনীয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা ওষুধ লেখেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ব্যবস্থাপত্র দেখে বলেন, চিকিৎসক এতো দামি দামি বিদেশি কোম্পানির ওষুধ না লিখে দেশি কোম্পানির ওষুধ লিখলে রোগীর সব মিলিয়ে ১৬শ টাকার মতো খরচ হতো। ওইসব বিদেশি ওষুধ অধিকাংশই নকল। এসব নকল ওষুধ সেবনে উপকারের চেকে ক্ষতির আংশকা বেশি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রভাষক সিহাব উদ্দিন বলেন, সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা প্রসারের সঙ্গে রোগীর অসন্তুষ্টি ও চিকিৎসকের বাণিজ্যিক মনোভাবের ঘটনাও বেড়েছে। মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকার শপথ নেয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেই উঠছে পেশায় অনৈতিকতা চর্চার অভিযোগ। মূলত বাণিজ্যিক মনোভাব ও খ্যাতির মোহ তাদের দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।
এবিষয়ে জেলা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মহেশ^র কুমার মন্ডল জানান, যদি অনিবন্ধিত বিদেশি ওষুধ ফার্মেসিতে কেউ বিক্রি করে, প্রমাণ পেলে অবশ্যই অধিদফতর ব্যবস্থা নেবে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে কোন ধরণের অনিয়ম বরদাশত করা হবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।