নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর পৌরসভার কাউন্সিলররা লোক নিয়োগ করে বাড়ির ময়লা নেবার নামে জোরপূর্বক টাকা আদায় করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি খোদ পৌর মেয়র স্বীকার করেছেন। এতে করে ক্ষোভ বাড়ছে নাগরিকদের মধ্যে। অনেক এলাকায় টাকা আদায়কারীদের সাথে নাগরিকদের বিবাদ হচ্ছে।
বিভিন্ন সেবার বিপরীতে খাতওয়ারি ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করে যশোর পৌরসভা। খাত অনুযায়ী এই হোল্ডিং করের মধ্যে সড়কবাতি, পয়ঃনিষ্কাশন ও ময়লা-আবর্জনা অপসারণ উল্লেখযোগ্য। বছরে তিনবার পৌর নাগরিকদের এই কর গুণতে হয়। কিন্তু তারপরও বাসাবাড়ির ময়লা ফেলতে ব্যয় করতে হচ্ছে মাসে বাড়তি আরো দেড়শ টাকা। এনজিও ও নিজেদের নিয়োগকৃত লোক দিয়ে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহের নামে ওই পরিমাণ টাকা আদায় করছেন পৌরসভার কাউন্সিলররা।
জানা গেছে, পৌরসভার ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্টটির ইজারাগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান দ্য এস্কেইট লিমিটেডের ফ্রি-তে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহের কথা ছিল। কিন্তু চাপ দিয়ে ইজারা চুক্তির এই শর্ত বাতিল করিয়েছেন কাউন্সিলররা। ফলে বিনা টাকায় ময়লা ফেলার সুযোগটি হারিয়েছেন পৌর নাগরিকরা। এতে ক্ষোভে ফুঁসছেন তারা।
কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ততায় বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহের নামে টাকা আদায় চলছে। এর সাথে পৌরসভার কোন সম্পৃক্ততা নেই : হায়দার গনী খান পলাশ, মেয়র, যশোর পৌরসভা
যশোর পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, শহরে মোট হোল্ডিং সংখ্যা ২৪ হাজার ৩৯টি। এর মধ্যে সরকারি হোল্ডিং ২৮৬টি ও ব্যক্তিগত ২৩ হাজার ৭৫৩টি। জানা যায়, ময়লা সংগ্রহের নামে শহরের অনেক এলাকায় এসব হোল্ডিং থেকে মাসিক ১৫০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। প্রত্যেক বাসাবাড়ি এই কার্যক্রমের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। অনেক হোল্ডিংয়ে একাধিক ভাড়াটিয়া থাকে। বিশেষ করে ‘ডাবল ইউনিট’র বহুতল ভবনের একেক তলায় দুটি করে ফ্লাট আছে। এক্ষেত্রে তিনতলা একটি ভবনের ফ্লাট সংখ্যা হয় ৬টি। প্রত্যেক ইউনিট থেকে দেড়শ টাকা আদায় করে নেয়া হয়, তাহলে আদায়ের পরিমাণ মাসে অর্ধকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মত পৌরবাসীর।
ময়লা ফেলতে নাগরিকদের এভাবে পকেট কাটা গেলেও বিড়ম্বনার ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ মুখছেন না। এনজিও কর্মীদের মাধ্যমে নাগরিকদের অনেকে ডাস্টবিনে ময়লা ফেলতে না চাইলেও বাধ্য করা হচ্ছে। এনজিও’র কর্মীদের কাছে ময়লা ফেলতে না দিলেও মাস গেলেই দেড়শ টাকা ঠিকই আদায় করা হচ্ছে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে যশোর পৌরসভায় কর্মরতদের বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, ঝুমঝুমপুরে যশোর পৌরসভার ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্টটি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ইস্কেইট লিমিটেডে’র কাছে ২০ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। ইজারা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ওই প্রতিষ্ঠানটি পৌরসভার হোল্ডিংগুলো থেকে বিনা টাকায় ময়লা সংগ্রহ করবে। কিন্তু কাউন্সিলররা তাদের নিয়োগকৃত এনজিও’র মাধ্যমে ময়লা সংগ্রহের কাজটি ছাড়তে নারাজ। কারণ, এসব এনজিও’র কাছ থেকে তারা মোটা অংকের এককালীন টাকা পেয়েছেন। তাছাড়াও বাসাবাড়ির থেকে প্রতিমাসে ময়লা সংগ্রহ বাবদ আদায় করা অর্থের একটি অংশ তারা পেয়ে থাকেন। যার জন্য কাউন্সিলরদের কেউ কেউ এনজিও’র মাধ্যমে ময়লা সংগ্রহের কাজটি হস্তান্তর করছেন না।
পৌর এলাকার বাসিন্দাদের বাসাবাড়ির ময়লা ফেলার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে ডাস্টবিন রাখা আছে। প্রতিদিন ভোরে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ডাস্টবিন থেকে ময়লা তুলে নিয়ে যায়। নাগরিকদের দেয়া হোল্ডিং কর থেকে এ বাবদ টাকা নেয়া হয়। অথচ বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে এনে ডাস্টবিনে ফেলার নামে মাসে ১৫০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।
জানা গেছে, পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের একটি অংশে ‘সম্মিলনী সেবা সংস্থা’ প্রত্যেক বাড়ি থেকে মাসিক ১৫০ টাকায় ময়লা সংগ্রহ করছে। তাদের মাধ্যমে ময়লা ফেলতে না চাইলেও নাগরিকদের মাস শেষে দেড়শ টাকার একটি রশিদ ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে এভাবে টাকা আদায় করা হচ্ছে।
পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বেজপাড়ার রফিকুল ইসলাম বলেন, বাসা বাড়ি থেকে পরিচ্ছন্নকর্মীরা এসে ময়লা নেয়া শুরু করেছে গত ৬ মাস ধরে। তারা মাসে ৫০ টাকা করে নিত। এখন পৌরসভার কাউন্সিলরের নাম করে মাসে ১৫০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। একটি ভবনে তিনটি পরিবার থাকলে তাদেরকে সাড়ে ৭শ টাকা দিতে হয়। এ যেন মগের মুল্লুক। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে হুমকি দেয়া হয়। অনেকে ঝামেলার ভয়ে টাকা পরিশোধ করছেন।
পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাবলু কুমার নাথ বলেন, পৌর নাগরিকরা ড্রেনে ময়লা ফেরার কারণে আমরা বাড়ি থেকে লোক দিয়ে ময়লা নেয়া শুরু করেছি। জোর করে টাকা নেয়া হচ্ছেনা। নাগরিকদের সুবিধার্থে একাজ করা হচ্ছে।
নাগরিকদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনের সাথে যুক্ত জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, পৌরসভার ট্যাক্সে পয়ঃনিষ্কাশন, সড়কবাতি ও ময়লা-আবর্জনা অপসারণসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন উল্লেখ আছে। খাতওয়ারি বিভিন্ন কর প্রতিষ্ঠানটি আদায় করে থাকে। কিন্তু কাউন্সিলররা তাদের নিয়োগকৃত লোক ও এনজিও’র মাধ্যমে ময়লা সংগ্রহের নামে যেভাবে টাকা নিচ্ছে এটি একদমই ঠিক না। ট্যাক্স দেয়ার পরও নাগরিকরা কেন ময়লা ফেলার জন্য আবারো বাড়তি টাকা গুণবেন। এটি পৌরসভার নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। এটি বন্ধ করতে হবে। নাগরিকরা যেহেতু অসংগঠিত; দাবি আদায়ে তাদের কোন সংগঠন নেই, যার কারণে এমনটি হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
এ ব্যাপারে যশোর পৌরসভার মেয়র বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার গনী খান পলাশ জানান, কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ততায় বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহের নামে টাকা আদায় চলছে। এর সাথে পৌরসভার কোন সম্পৃক্ততা নেই।