অধিকাংশ বিভাগে জেঁকে বসেছে অনিয়ম-দুর্নীতি
রশিদ ছাড়াই পরীক্ষা-নীরিক্ষা বাবদ টাকা নেয়ার অভিযোগ
তত্ত্বাবধায়কের দাবি সবাই আন্তরিক না হলে হয় না
সুনীল ঘোষ: যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর করেছে ‘শনির দশা’। অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সুচিকিৎসা নির্বাসনে গেছে। চিকিৎসকদের দলবাজি আর দালাল সিন্ডিকেটের অনৈতিক প্রভাবেও চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। চেইন অব কমান্ড বলতে কিছুই নেই। ওষুধ নেই। নেই পরীক্ষা-নীরিক্ষার সরঞ্জাম। এর ফলে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে দূর-দুরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের। রাজার তাল পুকুরে ‘ঘটি ডোবে না’ অবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালটি।
সোমবার চিকিৎসা নিতে আসেন আব্দুল খালেক নামে এক বৃদ্ধ। বেলা সোয়া ১১টা। সুমন নামে এক প্রতিবেশির ঘাড়ে হাত রেখে পৌঁছান হাসপাতালে। ডাক্তারও দেখান কিন্তু প্যাথলজি বিভাগ তাকে হতাশ করে। তিনি বলেন, আমি ডায়াবেটিকসের রোগী। কিন্তু টেস্ট করাতে পারলাম না। মাইয়ারা (নার্স) কইছে সব রকমের টেস্ট করানো বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালে এসে একটি এন্টাসিডও জুটলো না। এ সময় তার চোখে-মুখে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল। খাজুরা থেকে এসে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছি। গাড়ি ভাড়ায় যে টাকা খরচ হলো, সেই টাকায় বেশ কিছু ওষুধ কিনতে পারতাম।
বারবাজার থেকে চিকিৎসা নিতে আসা বাসন্তি দেবনাথ বলেন, এখানে চেয়ার-টেবিলও টাকা চায়! তদ্বির ও টাকা, দুটোই লাগে। হাসপাতালে না পেয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে দেড়শ’ টাকার ওষুধ কিনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন এই মধ্যবয়সী নারী।
যশোর সদরের বিরামপুর গ্রামের রহমত, আন্দোলপোতা গ্রামের আব্দুল করিম ও তার স্ত্রী সুরাইয়া বেগম সরকারি ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগ করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালের ফার্মেসি বিভাগে যোগাযোগ করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। অনেক জরুরি ওষুধের সরবরাহ নেই দাবি করেন দায়িত্বরত কর্মচারী। তার মুখে মাস্ক ছিল। নাম বলতে রাজি হননি তিনি। তিনি বলেন, ওষুধের সংকট লেগেই আছে। হাতে-গোনা কিছু ওষুধ আছে। গত এক মাসে ওমিপ্রেজল বা এন্টাসিডসহ গ্যাসের কোনো ওষুধ আসেনি। মাস কয়েক ধরে মৌসুমে রোগের ওষুধের সরবরাহ নেই। অতিগুরুত্বপূর্ণ মোনাস টেন, ফেক্সো, জিং সালফেটসহ অনেক ওষুধ নেই বলেও জানান এই কর্মচারী।
এ সময় জানতে চাওয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক বলেন ওষুধের সংকট নেই, কিন্তু ফার্মেসিতে ওষুধ মেলে না কেন ? তিনি বলেন, যান স্যারের গিয়ে বলেন। যেসব ওষুধ স্টোরে আছে তার তালিকা বোর্ডে আছে।
শহরের শংকরপুরের এএসকে সুমন নামে এক যুবক অভিযোগ করেন, রোববার দুপুর দেড়টার দিকে তিনি বেশ কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে যান। সেখানে রশিদ ছাড়াই টাকা চাওয়া হয়। তিনি বলেন, টাকাই যখন লাগবে তখন সরকারি হাসপাতালে লাইন না দিয়ে ক্লিনিকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করিয়েছি। তার অভিযোগ যশোর জেনারেল হাসপাতালে তদ্বিরের লোক থাকলে সব মেলে, না থাকলে কিছুই মেলে না। হাসপাতালে চেইন অব কমান্ড বলতে কিছুই নেই। যে যার মতো রোগীর পকেট কাটছে।
শহরের ষষ্টিতলাপাড়ার বাসিন্দা মুক্তি নন্দী জানান, বুধবার তিনি হাসপাতালে যান দুই মেয়ের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করাতে। ১৩২ নম্বর কক্ষে প্রচুর মানুষের ভিড় ছিল। ভিড় সামলে ভেতরে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে যায়। একপর্যায়ে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের পেপার হাতে পাই কিন্তু ২০০ টাকা চেয়ে বসে অল্প বয়সী এক যুবক। রশিদ ছাড়া টাকা কেন দেবো জানতে চাইলে ওই যুবক জানান এটা সরকারি ফিস। একপর্যায়ে পাশের চেয়ারে বসে থাকা আরেক ব্যক্তি ওই যুবককে ধমক দেন এবং আমাকে বলেন, দিদি আপনি যান। রশিদ ছাড়াই রক্ত পরীক্ষা বাবদ ১০০ টাকা নেয়ার অভিযোগ করেছেন নওয়াপাড়া পৌর এলাকার বাসিন্দা জিন্নাত আলী, পলাশী গ্রামের নিয়ামত আলী ও নারাঙ্গালী গ্রামের আফসানা বেগম। তারা জানান, সরকারি উপবৃত্তি পেতে বাচ্চাদের রক্তের গ্রুপ করাতে হচ্ছে। স্কুল থেকে চাওয়া হচ্ছে। সে কারণেই হাসপাতাল থেকে তারা রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করিয়েছেন। তাদেরও রশিদ দেয়া হয়নি।
সোমবার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক যান ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে দুপুর তখন ১২ টা ২৩ মিনিট। ১২৬ নম্বর কক্ষে গেলে চেয়ারে বসা এক নার্স জানান, রি-এজেন্ট শেষ। পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। ডাক্তার কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, হয়তো সুপার স্যারের রুমে আছেন।
সুপারের কক্ষের দরজায় ছিলেন জাকির আহমেদ নামে এক পিয়ন। তাকে দৈনিক কল্যাণের একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলা হয় তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামানের সাথে সাক্ষাত করতে চাই। ছেলেটি ফিরে এসে জানায় অপেক্ষা করতে হবে। স্যার ব্যস্ত আছেন। তখন দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট। দেখা আর মেলে না। একপর্যায়ে অফিস সহায়ক কামরুজ্জামানকে বলা হয়, কিন্তু তিনি বলেন, স্যার না ডাকলে যাওয়া যাবে না। অপেক্ষার প্রহর শুরু হয়। ডাক পড়ে দুপুর সোয়া একটায়। ঢুকতেই তিনি বলেন, খুব ব্যস্ত আছি, যা বলার বলেন।
ওষুধের সংকট উড়িয়ে দিয়ে বলেন, পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। এ সময় তাকে জানানো হয়, হাসপাতালের ফার্মেসি বিভাগের স্টোরে একটি এন্টাসিডও পাওয়া যায়নি। নেই অনেক জরুরি ওষুধ। এ সময় তিনি বলেন, ওষুধ আনতে হয় বগুড়া থেকে। গতকাল এসে গেছে, আগামীকাল পাবেন।
ডায়াবেটিস পরীক্ষার রি-এজেন্ট নেই প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি অস্বীকার করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডাক্তার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে মুঠোফোনে কল করেন। এ সময় তিনি বলেন, সাংবাদিকরা এসেছে, এখন আমি কী জবাব দেবো ? তাছাড়া আমারও ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেশিন গরম হতেই পারে কিন্তু আমাকে কেন জানানো হয়নি ? একপর্যায়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সবাই আন্তরিক না হলে হয় না। রি-এজেন্ট আছে দাবি করে তিনি ফের ব্লাড দিতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। যাওয়া হয় ১২৭ নম্বর কক্ষে। ব্লাড নিতে বলেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের ইনচার্জ মোস্তফা আলী। তখন পাশ থেকে বলা হয় সিরিঞ্জ নেই। এক পর্যায়ে তিনি রাগান্বিত হলে সিরিঞ্জ বের হয় একটি কাঠের আলমারী থেকে।
তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার আখতারুজ্জামানের বক্তব্যে স্পষ্ট বুঝা যায় হাসপাতালে কর্মরতরা চিকিৎসাসেবা নিয়ে আন্তরিক না। যে কারণে অনিয়ম-দুর্নীতি জেঁকে বসেছে।