সুনীল ঘোষ: যশোর বড়বাজারে সবজি বিক্রেতাদের রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বেচাবিক্রি শুরুর আগেই সব দোকানে পৌঁছে যায় ‘রেটকার্ড বার্তা’। কোন পণ্য কত দরে বিক্রি করতে হবে তা জানিয়ে দেয়া হয়। তাদের নির্ধারিত দর-দাম উপেক্ষা করে বিক্রির সুযোগ নেই ব্যবসায়ীদের। দিনে অন্তত তিন দফা দাম ওঠা-নামা করে। গলাকাটা সড়কের ভাড়া, চাঁদা ও খাজনাসহ বহুমুখী খরচ তুলতে দাম বেশি নিতে হয় বলে সবজি ব্যবসায়ীরা জানান। এর দায় এসে পড়ছে ভোক্তার কাঁধে।
সবজি ক্রেতা নিকমাল হোসেন, কলেজ ছাত্রী নূর নাহার (মেসের দায়িত্ব পালনকারী) ও খলিলুর রহমান জানান, বাজার ঘুরে লাভ নেই। সব দোকানে একই দাম। তবে বাজার ভেদে পণ্যের দর-দামে কম-বেশি আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন খুচরা সবজি বিক্রেতা দৈনিক কল্যাণকে জানান, যশোর বড়বাজারে দুই শ্রেণির সবজি বিক্রেতা রয়েছেন। এক শ্রেণির বিক্রেতা আড়ত থেকে সবজি কিনে বিক্রি করেন। আরেক শ্রেণির বিক্রেতা সরাসরি কৃষকের ক্ষেত থেকে সবজি সংগ্রহ করেন। কাকডাকা ভোর থেকে সবজি আসতে থাকে। তবে দোকান সাজিয়ে বসার আগেই সিন্ডিকেটের ‘রেটকার্ড’ পৌঁছে যায় দোকানির কানে। কোন পণ্য কত দরে বিক্রি করতে হবে তা জানিয়ে দেয় সিন্ডিকেট সংশ্লিষ্টরা। সূত্রের তথ্য মতে, সিন্ডিকেট নির্ধারিত দর-দাম উপেক্ষা করে কম বা বেশিতে বিক্রির সুযোগ নেই। নানাভাবেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সত্যতা যাচাইয়ের উপায় হিসেবে ঘুরে দেখা হয় সরেজমিনে।
কালিবাড়ি সংলগ্ন বেশ কয়েকজন দোকানিকে হাক-ডাক ছেড়ে আলু, পটল, বরবটি, কাঁচা মরিচ, ভেন্ডি, লাল ও সবুজ শাকসহ হরেক রকমের সবজি এক দরে বিক্রির চিত্র দেখা যায়। পূর্ব-পশ্চিম সড়কের দুইপাশে দোকানেও দেখা যায় ওই এক দরে সবজি বিক্রির করতে।
সকাল তখন সোয়া ৯টা। একটু এগিয়ে দক্ষিণের বাজারে (বরফ কল এলাকা) যান সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক। সেখানেও দেখা যায় এক দরে সবজি বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতা সেজে বেশ কয়েকটি দোকানে দর-দাম করে জানা যায় সব দোকানে একই চিত্র। আলুর কেজি সব দোকানে ১৬ টাকা। উচ্ছের কেজি ৬০ টাকা। কাচ কলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা দরে। পেঁয়াজ-রসুনেরও একই দাম। একটি দোকানও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেখানে সবজি জাতীয় অনন্ত একটি পণ্য ভিন্ন দরে বিক্রি করা হচ্ছে। এই চিত্রই বলে দেয়, সূত্রের দেয়া তথ্যের সত্যতা রয়েছে।
সদরের চুড়ামনকাঠির এক সবজি বিক্রেতা জানান, তিনি কৃষকের ক্ষেত থেকে সরাসরি সবজি সংগ্রহ করে বাজারে খুচরা দরে বিক্রি করেন। তিনি জানান, ৭ টাকা কেজির টমেটো সিন্ডিকেটের নির্দেশ মেনে ৩০ টাকা দরে বেচাবিক্রি করতে হচ্ছে। ২৬ টাকা দরের উচ্ছে বিক্রি করতে হচ্ছে ৬০ টাকা দরে। সবজি জাতীয় সব পণ্যের দর-দামে এই বিস্তর ফাঁরাক রয়েছে। তিনি বলেন, চাইলেও কমে বিক্রির সুযোগ নেই। ‘রেটকার্ড’ উপেক্ষা করলে হতে হয় হয়রানির শিকার।
এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার পর কিছু পণ্যের দাম কমানো হয়। তাও বার্তা পাওয়ার পর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই ফের সকালের দামে বেচাবিক্রি করতে হয়। চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দু’দফা দর কমে-বাড়ে। রাত ৮টার পর থেকে যাওয়া উদ্বৃত্ত সবজি অনেক কমে বিক্রি করে খালি করা হয় দোকান। এসব তথ্য জানান কয়েকজন সবজি বিক্রেতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিন্ডিকেট সংশ্লিষ্ট একজন জানায়, এক দশক আগেও সিন্ডিকেট ছিল না। সড়কের চড়াভাড়া ও খাজনাসহ বেশকিছু খাতে প্রতিদিন গুণতে হয় মোটা অংকের টাকা। প্রতিবাদ ধোপে টেকে না। উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব চিন্তা থেকে ২০১১ সালের দিকে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয় সিন্ডিকেট। অঘোষিত এই সিন্ডিকেট পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের পেছনেও নির্দিষ্ট অংকের টাকা খরচ হয়।
যশোর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ওয়ালিদ-বিন-হাবিব জানান, বাজার মনিটরিং করার পাশাপাশি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সবজির বাজারে মনিটরিং বাড়ানো হবে-যোগ করেন এই কর্মকর্তা।