রাজনীতির ছত্রছায়ায় মাদক
শিশু-কিশোররা বাহক
চারু আদিত্য: যশোরে মাদক ব্যবসায়ীরা বড্ড বেয়াড়া, বেপরোয়া। প্রশাসনের একটি অংশ ও সরকার দলীয় রাজনীতিকদের ছত্রছায়ায় শহরময় চষে বেড়াচ্ছে এ কারবারীরা। তারা ধরণ বদলেছে ব্যবসার। নতুন স্টাইলে চলছে বিকিকিনি। মাদক বহন ও বিক্রিতে ব্যবহার হচ্ছে শিশু-কিশোররা। ছোটখাটরা পাততারি গোটালেও বন্ধ হয়নি ‘মাদক মাফিয়া’দের কারবার। লুকোচুরি নয় মাদকের ব্যবসা এখন ওপেন সিক্রেট।
বদলে গেছে বিক্রির ধরণ
স্পটে বিক্রি ছাড়াও অফিস ও বাড়িতে মাদক পৌঁছে দেয়া হয়। ফেসবুক ম্যাসেনজার ও হোয়াসট আপে অর্ডার করলে অফিস ও বাড়িতে পৌঁছে নীল নেশা ইয়াবা, ফেনসিডিল ও আইস। মুঠোফোনে কল দিলে ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল যোগেও পৌঁছে দেয়া হয়।
ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে মাফিয়া স্টাইল
মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে দাগি সন্ত্রাসীরা। নিষিদ্ধ ব্যবসায়ের উপর সামাজিক চাপ ঠেকাতে চালানো হচ্ছে মাফিয়া স্টাইল। দাপট নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে অস্ত্রধারী বাহিনী গড়ে তুলেছে মাদক কারবারীরা। মাদকাসক্ত ও উঠতি সন্ত্রাসীদের বাহিনীতে ভিড়িয়ে নির্বিঘেœ ব্যবসা চালানো হচ্ছে।
বহন ও বিক্রিতে শিশুরা
ষষ্টিতলা বুনোপাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে চলে ইয়াবার কারবার। মুঠোফোনে আসে ‘বাবা’র অর্ডার। মাদক কারবারী ও সেবীদের কাছে নেশার এই ট্যাবলেটটি বাবা নামে পরিচিত। দুই রেটে বিক্রি হয় এই ‘বাবা’ ট্যাবলেট। বাড়ির শিশুদের মাধ্যমে মাদকাসক্তদের হাতে পৌঁছে যায় ইয়াবা ট্যাবলেট। পাড়ার বাসিন্দা বুনো মানিক ও নিশান এই এলাকায় একচেটিয়া ব্যবসা করে। অবাধে মাদক ব্যবসা চালানোর জন্য এলাকায় সন্ত্রাসী তৎপরতাও চালায় এই মাদক ব্যবসায়ীরা। আধিপত্য বিস্তারের জন্য সঙ্গে অস্ত্রও বহন করে। যাতে কেউ মাদক ব্যবসায় বাধা দেয়ার সাহস না করে। মাস ছয়েক আগে রিভলবার-গুলি ও ইয়াবাসহ আটক হয় নিশান। এরমধ্যে সম্প্রতি ইয়াবাসহ আটক হয় মানিকের স্ত্রী। মানিকও বেশ কয়েক দফায় অস্ত্রসহ আটক হয়েছে। দুই থেকে আড়াই বছর যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ সংলগ্ন একটি ছাত্রী মেস থেকে অস্ত্রসহ আটক হন মানিক। এরপর থেকে মাদক সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে সে।
পরিবারের সবাই মাদক কারবারী
মুজিব সড়ক বাইলেনে ইয়াবা বিক্রি হয় দেদার। এখানকার একটি পরিবারের সবাই ইয়াবা বিক্রির সাথে জড়িত। নান্টু ও অনুপ এখানকার মাদক ব্যবসায়ে মূলহোতা। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করে তার স্ত্রী ও বাবা-মা। সম্প্রতি নান্টু ও অনুপ দুইভাই পুলিশের হাতে আটক হয়। ইতোমধ্যে নান্টু জামিনে বেরিয়েছে। ছাড়া পেয়ে ফের ব্যবসা জোরদার করেছে।
ফেনসিডিল-ইয়াবায় ভাসছে পাখিপট্টি
কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হাফিজুর ইসলাম মরার মাদক সাম্রাজ্য এখন তার স্ত্রী রেখা খাতুনের হাতে। ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবাসহ সব ধরণের মাদকের ডিলার এই নারী। খুচরা ও পাইকারী দুভাবেই তার ব্যবসা চলে। বহুবার আটকের পরও থামেনি তার অবৈধ কারবার। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই ফের নিষিদ্ধ ব্যবসায়। মাদক বিক্রি ও বহনের কাজে শিশুদের কাজে লাগায় রেখা। এছাড়া মাদক বিক্রির জন্য তার রয়েছে একটি সংঘবদ্ধ দলও।
রেলগেট পশ্চিমপাড়ায় মাদকের ভ্রাম্যমাণ কারবারী
মাদক কারবারী রানা পরিবার পরিজন ও আত্মীয়দের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ফেন্সিডিলের বাজার। তার বোন ফাতেমা ও ভগ্নিপতি টালি বাবু মাদকের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। স্থানীয় শাহারিয়ার হোটেলের পেছনের এলাকায় নিজ বাড়ির পাশাপাশি ইজিবাইকে করে বিভিন্ন স্থানে মাদক পৌঁছে দেন তারা।
খড়কি কলাবাগান ভাসছে অস্ত্র-মাদকে
এমএম কলেজের দক্ষিণে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার কারণে বহুল আলোচিত নাম কলাবাগান। এখানে সাগর ও রমজান ফেনসিডিল, ইয়াবা ও অস্ত্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মা রেখাও একাজে জড়িত। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্র্রণে তারা এলাকায় সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়। রেখা আত্মরক্ষায় বোমা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কলেজ সংলগ্ন এলাকার বেশকিছু দোকানিকে তাদের ইয়াবা ও ফেনসিলি বেচাবিক্রিতে বাধ্য করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা প্রভাবশালী হওয়ায় নিরবে মেনে নিতে হয় তাদের অনৈতিক আবদার।
রায়পাড়ায় বিক্রি হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক
আম বাবুর ছেলে রশিদ, প্রিন্স, রানা ও তার মা জোহরার রয়েছে একটি মাদক সিন্ডিকেট। তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যদের কাছ থেকে কেনা ফেনসিডিল ও ইয়াবা বিক্রি করে। এই সিন্ডিকেট সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে টাকা নেয় মিরাজ নামে পুলিশের এক এসআই। যেকারণে তারা প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
বারান্দিপাড়ার লিচুতলায় মাদকের নিত্য হাট
শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আবু তালেব কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তার মাদক সা¤্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেন ভাতিজা জাকির হোসেন টুটুল। মাদকবিরোধী অভিযানের কারণে তিনি গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তবে তার পোষ্য কারবারীরা মাদকের হাট বসিয়ে বেচাবিক্রি অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
আরেক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর নাম জাকির হোসেন রাজিব। তিনি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা। পুলিশের দালাল হিসেবে পরিচিতি। পুরাতন কসবা কাঁঠালতলা এলাকায় আলোচিত একটি অফিসে ওঠাবসা তার। সেখানকার জোরে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে অবাধে চলছে তার মাদক কারবার।
টিবি ক্লিনিকপাড়া ও শংকরপুরে মাদকের নিয়ন্ত্রণে সাবেক কাউন্সিলরের ভাই
বেজপাড়া টিবি ক্লিনিকপাড়া ও শংকরপুরে রয়েছে মাদকের সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেট। গোলাম রসুল ডাবলু এই সিন্ডিকেটের প্রধান। তিনি সাবেক এক কাউন্সিলরের ছোট ভাই। রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া পরিবারটির বেশ কয়েকজন সদস্য সিন্ডিকেট দেখভাল করেন। গত পৌর নির্বাচনে কাউন্সিলরের নেতৃত্বের হাত বদল ঘটে। এর প্রভাব পড়ে স্থানীয় রাজনীতি ও মাদক ব্যবসায়। এতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ডাবলু। এক প্রতিপক্ষকে মার্ডার করতে মরিয়া ডাবলু পেশাদার কিলার ছানিকে পাঠান কিন্তু উল্টো ছানি নিজেই সেখানে খুন হয়। এসব অভিযোগ স্থানীয়দের। ছানি নিহত হওয়ায় পর তার বোন বুচিকে মাদক সিন্ডিকেটে নেয় ডাবলু। মাদকের ব্যবসায় জড়িয়ে বুচি এখন বেশ আলোচিত। মাদক বেচাবিক্রি করে সংসার চলে তার। সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য সম্রাট। বস্তির নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। সেখানে ইয়াবা-গাঁজা ও ফেনসিডিলের ব্যবসা এখন তুঙ্গে। এরআগে সিন্ডিকেটের অন্যতম ক্যাডার ছিল ট্যাবলেট সোহেল ও আনসার ক্যাম্প এলাকায় মুন্না। শোনা যায় সোহেল নিরুদ্দেশ হওয়ায় ডাবলুর মাদক ব্যবসায় কিছুটা হলেও ধস নামে। যদিও তাদের মাদক রাজ্যে বেচাবিক্রি কখনো বন্ধ হয়নি
সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ ছাত্রনেতার মাদক কারবার
কলেজটিতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের এক শীর্ষ নেতার ছত্রছায়ায় চলছে মাদকের কারবার। তার অনুসারী বিপদগামী কিছু শিক্ষার্থী মাদক বিক্রি ও সেবনের সাথে জড়িত। সন্ধ্যার পর কলেজের পেছন পাশে মহিলা হোস্টেলের আশপাশে চলে মাদক সেবন ও বেচাবিক্রি। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজনীতির নামে ওই ছাত্রনেতা মাদক সেবিদের জড়ো করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
যশোরে শীর্ষ মাদক কারবারির তালিকায় যাদের নাম
শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে পরিচিতি রয়েছে বাদশা মল্লিকের। তিনি ভারতে অস্ত্রসহ আটক রয়েছেন বলে শোনা যায়। শংকরপুরের মাদক ব্যবসায়ী তারেক সৌদি আরব এবং আরও কয়েকজন ভারতে গা ঢাকা দিয়ে আছে বলে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক সূত্রে জানা গেছে। লিচুবাগান এলাকার কাইল্যা তপন, টালিখোলা এলাকায় উজ্জ্বল, জিহাদ, সুমন, মনু, কাঁঠালতলা এলাকায় বেড়ে টুটুল, পালবাড়ি এলাকায় লাভলু, খয়েরতলা এলাকায় রবিউল ইসলাম রবি শীর্ষ মাদক কারবারী হিসেবে পরিচিত। তাদের গডফাদার নামে পরিচিত পুরাতন কসবা এক যুবলীগ নেতা। পেশায় তিনি ঠিকাদার হলেও তার অবৈধ আয়ের প্রধান উৎস চাঁদাবাজি, ইয়াবা কারবার ও জুয়ার আসর। পালবাড়ির ওয়ান-টেন জুয়ার আসরের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। পুরাতন কসবা এলাকায় চিহিৃত একদল ক্যাডার তার ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৪ মে তৎসময়ের এসপি আনিসুর রহমান তালিকাভুক্ত ১৪ মাদক ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেন। তারা হলেন- চাঁচড়া রায়পাড়ার বেবি খাতুন, রুমা বেগম, শংকরপুর এলাকার তারেক কাজী, চৌগাছার কাবিলপুর গ্রামের শফি মেম্বার, অভয়নগরের বুইকরা গ্রামের কামরুল ও লিপি, বেনাপোল ভবেরবেড় গ্রামের রবিউল ইসলাম, বারপোতা গ্রামের রিয়াজুল ইসলাম, চৌগাছার ফুলসারা এলাকার আশরাফুল, কাবিলপুর এলাকার ইসরাইল হোসেন নুনু, শার্শার আনোয়ার হোসেন আনা, বাদশা মল্লিক ও জাহাঙ্গীর। সে সময় এসব মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করেন করেন এসপি আনিসুর।
যশোরে তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা কত জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) জাহাঙ্গীর আলম জানান, প্রতিনিয়তই আপডেট হচ্ছে। এ মুহর্তে সুনির্দিষ্ট করে সংখ্যা বলা সম্ভব না।
মাদক দ্রব্য অধিদপ্তর যশোর অফিসের উপ-পরিচালক (অতিঃদায়িত্ব) বাহাউদ্দিনকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমি ঢাকায় আছি তাই কোন তথ্য দেয়া সম্ভব না।
একই অফিসের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা রাশেল আহমেদ জানান, উপপরিচালকের অনুমতি ছাড়া তথ্য দেয়ার ক্ষমতা তার নেই।