আবদুল কাদের
৩ বছর আগে পরিবহন খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু এ খাতের কোনো শ্রমিক নির্ধারিত নিম্নতম মজুরি পাচ্ছেন না। যশোরের অধিকাংশ বাস এখনো চুক্তি ভিত্তিতে চলছে। নির্দিষ্ট বেতন বা মজুরি না থাকায় চালক ও সহকারীরা বেশি যাত্রী ও ট্রিপের জন্য বেপরোয়াভাবে বাস চালানো বন্ধ করছেন না। শ্রমিকরা বলছেন, বর্তমান অস্বাভাবিক বাজার ব্যবস্থায় পরিবার নিয়ে চলতে পারছি না। যেকারণে বেশি ট্রিপের জন্য জীবন বাজি রাখতে হচ্ছে। বাস শ্রমিকদের নিয়ে সরকার বা মালিকদের কোন চিন্তা নেই। যশোরের ১৩ হাজার পরিবহন শ্রমিক মানবেতন জীবন যাপন করছে।
২০২০ সালের ২১ জুলাই পরিবহন শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন পরিবহন খাতের শ্রমিকদের জন্য নি¤œতম মজুরি নির্ধারণে শ্রম আইন অনুযায়ী বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ড একাধিক সভা শেষে নিম্নতম মজুরির সুপারিশ করে। মূল বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও যাতায়াত ভাতা মিলিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে মোট মজুরি।
মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী, ভারী, মাঝারি ও হালকা যান চালানোর লাইসেন্সের ভিত্তিতে চালকদের বেতন নির্ধারণ করা হয়। আলাদা করা হয়েছে বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য এলাকা ভিত্তিতে চালকদের বেতন। এ বিভাজনের ভিত্তিতে একজন চালকের বেতন সর্বোচ্চ ২০ হাজার ২০০ থেকে সর্বনিম্ন ১৪ হাজার ৪৪০ টাকা পর্যন্ত।
বাসের কনডাক্টর (পরিচালনাকারী), সুপারভাইজার (তত্ত্বাবধায়ক), চেকার (পরীক্ষক), বুকিং ক্লার্ক, গাইড ও ক্যাশিয়ারদের দক্ষ শ্রমিক হিসেবে ধরা হয়েছে। বিভাগীয় শহরে তাদের নিম্নতম বেতন ১৩ হাজার টাকা ও অন্যান্য এলাকার জন্য ১২ হাজার ২০০ টাকা, আর চালকের সহকারীদের (হেলপার) নিম্নতম বেতন বিভাগীয় শহরে ১০ হাজার ৭৫০ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ১০ হাজার ১০০ টাকা করা হয়।
মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী, কোনো মালিক পরিবহন শ্রমিককে এ নিম্নতম মজুরির কম দিতে পারবেন না। প্রতিবছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে শ্রমিকদের বেতন বাড়বে। ২০০৬ সালের শ্রম আইন ও ২০১৫ সালের শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী অন্যান্য ভাতা ও সুবিধাও পাবেন তারা।
যশোর পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা মিঠু বলেন, ৩ বছরেও নি¤œতম মজুরি বাস্তবায়িত না হওয়া দুঃখজনক। নিয়োগপত্র, বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো মজুরি বোর্ডের গেজেটে বলা আছে। এই নিম্নতম মজুরি মানার ক্ষেত্রে মালিকদের অনীহা রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে সরকারের বেঁধে দেয়া বেতন কাঠামো দিয়েও শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে চলতে পারবেনা। কারণ এখন কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা আয় না হলে কোন পরিবার খেয়ে বাঁচতে পারবে না। আমরা বারবার এনিয়ে আন্দোলন করেছি, কিন্তু সরকার বা মালিক পক্ষ কোন উদ্যোগ নেয় না। এমনও শ্রমিক রয়েছেন যাদের বেতন ৪০ বছরেও বাড়েনি। অথচ শ্রমিক সংখ্যা বেড়েছে। চালকরা তাদের লাইসেন্স নবায়ন করে সরকারকে ভ্যাট দিচ্ছে। অথচ তাদের কথা সরকার মনে রাখছে না। আমাদের ইউনিয়নের ১০ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। সরকারিভাবে কোন প্রণোদনাও দেয়া হয় না আমাদের।
একে ট্রাভেলসের কাউন্টার ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত খোকন মিয়া বলেন, মাসে ৯ হাজার টাকার বেতনে চাকরি করছি। ৩ ছেলে মেয়ে নিয়ে পরিবারের খরচ চালাতে আতœীয় স্বজনদের কাছে হাত পাততে হয়।
মণিহার এলাকায় কলারম্যান হিসেবে দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছে শহরের বেজপাড়ার শাহআলম। একটি দুর্ঘটনায় তার দুই হাত কাটা পড়েছে। প্রতিদিন তার বেতন মাত্র ২শ টাকা। এতে তার ছেলে-মেয়েদের তিনি ঠিকমত লেখাপড়া করাতে পারেননি। কোন মাসে একবার আধাকেজি মাংস কিনে পরিবারকে খাওয়ান। ছেলেমেয়েদের কোন আবদার পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না।
শ্রমিকরা জানান, লোকাল রুটে তাদের কারও বেতন নির্ধারিত নয়। যত ট্রিপ, তত টাকা এই চুক্তিতে বাস চালাচ্ছেন। মালিকের জমা, লাইন খরচ (বিভিন্ন খরচ), জ্বালানি খরচ ও নিজেদের খাওয়ার খরচ বাদ দেওয়ার পর চালক ও সহকারী তাদের আয় বুঝে নেন। অনেক সময় যাত্রী সংকটে চালক, হেলপাররা দিনে ২-৩শ টাকা করে পেয়ে থাকেন।
নিম্নতম মজুরির পাশাপাশি বাস শ্রমিকদের জন্য ওভারটাইমের (অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা) টাকাও দেয়া উচিত বলে মনে করেন যশোর সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বিশ্বনাথ ঘোষ বিষু। তিনি বলেন, লোকাল রুটে ট্রিপভিত্তিক বেতনের কারণে চালকদের মধ্যে বেপরোয়া চালানোর তাড়া থাকে। অথচ চালক সহকারীর বেতন হিসাব করেই বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মালিকেরা নির্ধারিত বেতন দেন না। আমাদের সমিতির আওতায় ৩ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। তাদের নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়নে আমরা উদ্যোগী হবো। তিনি বলেন, একজন ঢাকা রুটের পরিবহন চালক মাসে ১৫ হাজার টাকা, সুপারভাইজার ১০ হাজার ও হেলপার পেয়ে থাকেন ৭-৮ হাজার টাকা। আর লোকাল রুটে বেতন নির্ধারণ হয়ে থাকে ট্রিপ শেষে খরচ ও মালিকের টাকা বাদে যে টাকা থাকে তার উপর ভিত্তি করে। এতে পরিবার নিয়ে কিভাবে চলবে। কেননা বর্তমানে বাজার করতে গিয়ে বাড়ি ভাড়া দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এব্যাপারে যশোর বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফ চাকলাদার বলেন, আমরা বাস শ্রমিকদের সাথে মিলেমিশে পথ চলে থাকি। বর্তমান বাজারে তাদের চলতে কষ্ট হচ্ছে আমরাও বুঝি। কিন্তু যাত্রী কমে যাবার কারণে আমাদের আয়ও কমে গেছে। তারপরও কিভাবে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো যায় তা নিয়ে কাজ করবো।