রায়হান সিদ্দিক
‘আজ যখন আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি ঠিক তখন আমার সোনাডা কবরের অন্ধকারে ঘুমায় আছে। যে স্বাধীনতার জন্য আমার সোনাডা জীবন দিলো সেই স্বাধীনতা যেন বিনষ্ট না হয় সেজন্যি সকলকে সজাগ থাকতি হবে। ওই স্বৈরাচার সরকার যেন আর কোন দিন এদেশের মাটিতে পা রাখতি না পারে সেজন্যি আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতি হবে। নাহলি আমার সোনার রক্ত বিথা হয়ে যাবে।’ এভাবেই অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন জুলাই-আগস্টের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে নিহত আব্দুল্লাহর পিতা আব্দুল জব্বার। ২০২৪ এর জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের স্মরণে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে যশোরে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। শনিবার বিকেলে জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে আয়োজিত সন্তানহারা পিতার বক্তব্য শুনে অশ্রুসিক্ত হন উপস্থিত অতিথিরাও।
নিহত আব্দুল্লাহর পিতা আব্দুল জব্বার বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশের শান্তি বিনষ্ট করতে বিভিন্ন মহল নানান ষড়যন্ত্র করছে। তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নিহত ইমতিয়াজ আহমেদ জাবিরের পিতা নওশের আলী বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে খুনিদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা শান্তি পাবো না।
নিহত তৌহিদুল ইসলামের পিতা আব্দুল জোব্বার মোল্লা বলেন, বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কতটা ভারি তা আমি একজন পিতা হিসেবে উপলব্ধি করেছি। কিন্তু আমার সন্তান এই দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। তাই আমি বলি আমি একজন গর্বিত পিতা। কিন্তু যদি চক্রান্তকারীরা সফল হয় তাহলে এত মানুষের আত্মত্যাগ মূল্যহীন হয়ে যাবে। তাই আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। স্মরণ সভার শুরুতে একমিনিট নিরবতা পালন ও পরে দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
স্মরণসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল মজিদ বলেন, শহীদের ঋণ আমরা শোধ করতে পারবো না। তবে যেদিন বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদমুক্ত হবে সেদিন আমরা মনে করবো শহীদদের রক্ত বৃথা যায়নি। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। তাদের বাঁচাতে চলছে নানা তদবির। তদবির যারা করছে তারাও ফ্যাসিস্ট।
সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীনতা পায়নি। ৭১ সাল থেকে ২৪ সাল পর্যন্ত বলতে হয়েছে স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতা পায়নি। আমাদের কি আবারও নতুন বাংলাদেশের জন্য লড়াই করতে হবে। এই প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে হবে। যে প্রত্যাশা নিয়ে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। আমামদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে যাতে নতুন করে কোন ফ্যাসিবাদ তৈরি হতে না পারে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পুলিশ সুপার জিয়া উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই বিপ্লবে স্বৈরাচার সরকার তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। যার কারণে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এতে যেমন ছাত্র জনতা শহীদ হয়েছে ঠিক তেমনি ৪৪ জন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। এই দায়ভার তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীকেই নিতে হবে।
৪৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, বিজিবি ছাত্র জনতার সাথে ছিলো। আমরা চেষ্টা করেছি যেন এই অভ্যুত্থান সফল হয়। পাশাপাশি আমরা এখনো সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
সিভিল সার্জন ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, যশোরে ২৭ জন শহীদ ও ৪১ জন আহত হয়েছে। যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত হতে পেরেছি। আরও যাচাই বাছাই চলমান রয়েছে। স্মরণসভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. রুহুল আমিন, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন, জেলা জামায়াত ইসলামীর সেক্রেটারি অধ্যাপক গোলাম কুদ্দুস, প্রেসক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের আহ্বায়ক রাশেদ খান, সদস্য সচিব জেসিনা মুর্শিদ প্রাপ্তি, যুগ্ম সদস্য সচিব জান্নাতুল ফোরা অন্তরা, ছাত্র প্রতিনিধি মারুফ হাসান সুকর্ণ, মাসুম বিল্লাহ, হাবিব আহমেদ সান প্রমুখ।