এইচএম রোডের ৫০০ দোকান থেকে প্রতিদিন দেড় লাখ টাকা আদায়
সক্রিয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মালিক আর প্রভাবশালী চক্র
নির্বিকার পৌরসভা ও প্রশাসন
সুনীল ঘোষ: পৌরসভার রাস্তা বেচে খাচ্ছে বাড়ি মালিকসহ চিহ্নিত প্রভাবশালী মহল। বাদ পড়ছে না অলি-গলির সরু পথও। এই বেচাবিক্রির দর এতটাই চড়া, যা শুনলে আৎকে উঠবেন বিবেক সম্পন্ন মানুষ। তাও মাসিক বা সাপ্তাহিক না, গলাকাটা এ টাকা গুণতে হয় প্রতিদিন। যেকারণে পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে বেচাবিক্রি করতে বাধ্য হন দোকানিরা। দিন শেষে খুচরা বিক্রেতার হাত ঘুরে দেড় লক্ষাধিক টাকা চলে যায় বাড়িওয়ালাসহ প্রভাবশালী চক্রের পকেটে। গড় হিসেবে মাসে চক্রটি পৌর সড়ক বেচে-কিনে খাচ্ছে অর্ধকোটি টাকার ওপরে। পাশাপাশি বাজারের ইজারাদারও অবৈধ এসব দোকান থেকে খাজনা আদায় করনে। এই চিত্র যশোর শহরের সবজি বাজারের।
দৈনিক কল্যাণের তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা যায়, সবজির বড় বাজার ঘিরে অস্থায়ী দোকান বসে প্রায় ৫০০। কাক ডাকা ভোরে পৌর সড়কের ওপরে সবজি ছাড়াও হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন ভাসমান দোকানীরা। হাক-ডাক ছেড়ে তারা বেচাবিক্রি করেন রাতঅবদি। পৌর সড়কের দুইপাশ ঘিরে এসব দোকান। হাজী মুহম্মদ মহসিন সড়কের (কালিবাড়ি রোড) দু’পাশ ও বরফকলের পূর্ব-দক্ষিণ ও উত্তর পাশ ঘিরে সবজিসহ নানা পণ্য বিক্রির অস্থায়ী দোকানের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০০। সবজির বাজারের শুরু মনসা বস্ত্রালয়ের ঠিক পূর্ব-উত্তর দিক থেকে। দু’পাশ বেয়ে চলে গেছে একদম কাঠের ব্রিজ পর্যন্ত। সেখান থেকে গলিপথ বেয়ে সবজি ও ফলমূলের বাজার চলে গেছে বরফকল পর্যন্ত। বরফকলের আশপাশে অস্থায়ী দোকান রয়েছে দুই শতাধিক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়ির সামনে পৌর সড়কে দোকান বসিয়ে গলাকাটা ভাড়া তুলে খাচ্ছেন বাড়ির মালিক। আবার কিছু স্থায়ী দোকানের মালিক তার সামনে পৌর সড়কে ভাসমান দোকান বসিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা।
এসব দোকান বসায় কারা ও নিয়ন্ত্রণই বা করে কারা তা খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর ও অমানবিক তথ্য। সড়কে দোকান বসিয়ে গলাকাটা ভাড়া আদায় করছে দুই শ্রেণির মানুষ। এক শ্রেণি হলো বাড়িওয়ালা, অন্যটি হলো প্রভাবশালী মহল। বাড়িওয়ালা মনে করেন তার বাড়ি ঘেঁষে নির্মিত পৌরসভার সড়ক ভাড়া দিয়ে খাওয়ার অধিকার রয়েছে তার। অধিকাংশ বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক পৌরসড়কে ভাসমান দোকান বসিয়ে বছরের পর বছর লুটে খাচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। অন্যদিকে বসে নেই প্রভাবশালী মহল। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে সন্ত্রাসী লালন-পালনের অভিযোগ। এসব সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয় ব্যক্তি স্বার্থে। এসব পা চাটা সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে যেখানে সেখানে, এমনকি লোক চলাচলের সরু পথেও যত্রযত্র ভাসমান দোকান বসিয়ে প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। প্রভাবশালী এই চক্রটি নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে জোর করে ভাসমান দোকান বসিয়ে গলাকাটা ভাড়া আদায় করছে-এমন অভিযোগ একাধিক জনের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিন সবজি দোকানি এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, সবজি বাজার ঘিরে মাসে অর্ধকোটির ওপরে ভাড়া নেয় বাড়িওয়ালা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মালিক ও প্রভাবশালী একটি চক্র। বরফকল এলাকায় দুই পৌর সড়কের এক স্কয়ার ফুট জায়গায় দোকান দিলে ভাড়া দিতে হয় ২০০ টাকা। ৪ স্কয়ার ফুট জায়গার ভাড়া আদায় করা হয় সর্বনিন্ম ৩৮০ টাকা। তবে জায়গার পজিশন ভাল-মন্দের ওপরও নির্ভর করে ভাড়ার পরিমাণ। গলাকাটা ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুটো জিনিস ফলো করা হয়। একটি হলো লোকেসন, অন্যটি জায়গার পরিমাণ। কোনো কোনো বাড়ির সামনে দেখা গেছে ৪-৫ টি সবজির দোকান। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মালিক চড়াহারে ভাড়া চুক্তিতে ৬-৭টি ভাসমান দোকান বসিয়ে দিন শেষে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। বরফকল এলাকায় সর্বনিন্ম ২০০ এবং সর্বোচ্চ ৫০০ করে টাকা আদায় করা হয় ভাসমান দোকান থেকে।
তবে কালিবাড়ি সড়কে ভাসমান দোকানের ভাড়া সবচেয়ে বেশি। এখানে সর্বনিন্ম ৪০০ এবং সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে বাড়ি ও স্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মালিকদের বিরুদ্ধে। এরবাইরে রয়েছে ইজাদারের খাজনা। খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে বলপ্রয়োগের অভিযোগ। বাইসাইকেলে ফলমূল বিক্রেতাদের কাছ থেকেও জোর করে সর্বনিন্ম ৩০ টাকা খাজনা আদায় করা হচ্ছে।
কালিবাড়ি সড়কের ভাসমান দোকানী নিকমাল হোসেন বলেন, সবজির ন্যায্য দাম পান না কৃষক। মধ্যস্বত্বভোগী চক্রের কারসাজির কারণে প্রায় সারাবছর সবজির বাজার চড়া থাকে। কয়েকগুণ বেশি দামে সবজি বিক্রি করতে হয় গলাকাটা ভাড়ার কারণে।
তিনি বলেন, কোন পণ্যের বাজার কোথায় বসবে তা ঠিক করে পৌরসভা ও জেলা প্রশাসন। যশোরের বড়বাজারেও সবজি বাজার রয়েছে। তারজন্য খাজনা গুণতে হয়। কিন্তু পৌর সড়ক ভাড়া দিয়ে খাওয়ার নজির সৃষ্টি হয়েছে এখানে। বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মালিক এবং প্রভাবশালী মহলের বাইরে বা বিনানুমতিতে ভাসমান দোকান দেয়ার সুযোগ নেই যশোর বড়বাজারে নেই।
তিনি বলেন, গলাকাটা ভাড়ার বিরোধীতা করা হলে নেমে আসে নানামুখী অত্যাচার। দোকান বসতে দেয়া হয় না। মারপিটের শিকারও হতে হয়। এসব কারণে খুচরা সবজি বিক্রেতারা ভাড়ার বিরোধীতা না করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে বেচাবিক্রি করেন।
তিনি মনে করেন প্রশাসনই পারে দীর্ঘদিনের অমানবিক এই কর্মকান্ডের অবসান ঘটাতে। কিন্তু সেই প্রশাসনই নিরব-নির্বকার। পৌরকর্তৃপক্ষেরও নড়ন-চড়ন নেই।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বড়বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোশরাফ হোসেন বাবু দৈনিক কল্যাণকে বলেন, আমি ইজারা নিই। তাই আমার লোকজন খাজনা তোলেন। পৌরসভার সড়কে দোকান বসিয়ে গলাকাটা ভাড়া আদায়ের বৈধতা আছে কি-না এমন প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেন, ভাড়া দিয়েও তো ভাসমান দোকানিরা লাভ করেন। গলাকাটা ভাড়া দিতেই খুচরা দোকানিরা পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে বিক্রি করে, যার মাশুল গুণতে হয় ভোক্তার- এ বিষয়ে তিনি বলেন, তা তো ঠিক।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মাছ বাজার পৌরসভার। কিন্তু সবজির বাজারের জায়গা দেয়নি পৌর কর্তৃপক্ষ। যে কারণে প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি মালিকরা পৌরসড়কে দোকান বসিয়ে ভাড়া আদায়ের সুযোগ পেয়েছেন। আর আমরা খাজনা আদায় করি।
এ ব্যাপারে যশোর পৌরসভার মেয়র হায়দার গনী খান পলাশের ব্যবহৃত মুঠোফোনে কয়েক দফা কল করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে পৌরসভার সচিব আজমল হোসেন দৈনিক কল্যাণকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খোঁজ নিতে বলবো। সত্যতা পাওয়া গেলে নেয়া হবে আইনী ব্যবস্থা।