জাহিদ হাসান
‘যেখানে যা ছিলো, সব ঠিক আছে। টেবিলে সারিসারি বই, সাজ্জসজ্জার কসমেটিক। আছে ব্যবহৃত কাপড় চোপড়সহ প্রয়োজনীয় সব জিনিস। এক ইঞ্চিও সরাইনি। সবাই সরাতে চাই। কিন্তু আমি সরাইনি। কারণ আমি জানি আমার মেয়ে এই ঘরেই আছে। কথাগুলো বলছিলেন যশোরের ঝিকরগাছা বদরুদ্দীন মুসলিম (বিএম) হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী অনি রায়ের মা কনিকা রায়। গত ২৭ মার্চ সকালে বখাটেরা উত্ত্যক্ত করায় অনি নিজ বাসাতে আত্মহত্যা করে। উপজেলার হাসপাতাল রোড মিস্ত্রিপাড়া এলাকার গৌতম রায়ের মেয়ে। গত বৃহস্পতিবার ধর্মীয় আচাররীতি মেনে শ্রাদ্ধ সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে, সদা হাস্যজ্জল চঞ্চল অনি কেন আত্মহত্যায় বাধ্য হলো, সেই প্রশ্নের সদুত্তর মিলছে না। ওইদিন স্কুলের ভিতর কি ঘটেছিল, সেটি নিয়ে ধুম্রজাল রয়েছে। তবে স্কুলের বাইরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে তিন কিশোর তার পিছু নিয়ে ধাওয়া করছে। এরপর বাড়িতে গিয়ে আত্মহত্যা করে অনি। ঘটনার পর স্কুলের প্রধান শিক্ষক, থানা পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। তারা ঘটনাটিকে শুধুই আত্মহত্যা বলে আড়াল করতে চেয়েছিল। পরে স্বজন ও এলাকাবাসীর তোপের মুখে আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা ও একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
অনি রায়ের বাড়িতে যেয়ে দেখা গেছে, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের ভিড়। বাড়ির ভিতরে অশ্রু চোখে বসে ছিলেন অনি রায়ের মা কনিকা রায়। বারবার মেয়ের অনেক কথা স্মৃতি চারণ করে কাঁদছেন আর শাড়ির আঁচড় দিয়ে চোখ মুচছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই একপর্যায়ে তিনি উঠে দাঁড়ান এবং অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে এ প্রতিবেদককে নিয়ে যান অনির ঘরে। অনির ব্যবহৃত জিনিসপত্র ঘেটে ঘেটে দেখান। দেখা গেছে সাজানো আছে বই, সাজসজ্জার সব জিনিস আর নতুন একটি স্কুল ব্যাগ। পাশেই মেয়ের অনেকগুলো ছবি। অশ্রু মুছে কনিকা রায় বলেন, ‘কত সুন্দর করে সাজতো মেয়েটা, কতই না সুন্দরই লাগতো তার। সাজুগুজু করে ছবি তুলে ওয়াশ করে এ্যালবাম করার শখ ছিলো। সেই মেয়েই এখন ছবি হয়ে গেল! মেয়ের নানা প্রশংসা করে তিনি আরো জানান, ‘মেয়েটার চেহেরা সুন্দর হওয়াতে আমরা বলতাম, তোকে বেশি পড়াবো না। সুন্দর দেখে একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবো। কিন্তু মেয়ের কত স্বপ্ন ছিলো। ও বলতো-না! আমি বিয়ে করবো না। লেখাপড়া করে মানুষ হবো। পুলিশ হবো। কত স্বপ্ন ছিলো ভগোবান……..আহ! সেই স্বপ্ন মুছে দিলো বখাটেরা। আমার বুক যারা এভাবে খালি করে দিলো তাদের বিচাই চাই…।

অনি রায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে গত বুধবার মা কনিকা রায় আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য তিনজনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেছেন। মামলার আসামিরা হলো, মোবারকপুর হাসপাতাল রোড এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে সাকিব উদ্দিন (১৬) এবং গ্রেফতার হওয়া চন্দ্রপুর গ্রামের মৃত মুরাদ হোসেনের ছেলে মেহেদি হাসান তামিম। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরো দুই তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলা অনি রায়ের মা কনিকা রায় উল্লেখ করেছেন, গত ২৭ মার্চ সকাল ১০ টা ১০ মিনিটের দিকে স্কুলে কোচিং শেষ করে বাড়িতে ফিরছিলো অনি। পথিমধ্যে স্কুলের পাশে নির্মাণাধীন দোকানের কাছে পৌঁছালে দশম শ্রেণির ছাত্র মেহেদী হাসান তামিম, সাকিব উদ্দিনসহ কয়েকজন অনি রায়কে দাঁড়াতে বলে। অনি না দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করে। এ সময় মেহেদী হাসান তামিম অনি’র হাত ধরে টান দিয়ে দাঁড় করায়। এরপর তামিম, সাকিব ও তার সহযোগিরা অনি রায়কে বিভিন্ন রকমের কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল কথাবার্তা বলে। প্রকাশ্যে এমন আচরণ করায় কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে এসে আত্মহত্যা করে। আর স্কুলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে স্কুল থেকে বের হওয়ার পর কয়েকজন কিশোর অনিকে ধাওয়া করছে। ভয়ে দৌঁড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে অনি। আত্মহত্যার পর তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালের মোড়ে ওই কিশোরদেরকে দেখা যায়। এঘটনায় জড়িতদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের।
মেয়ের বড়ভাই অর্ঘ্য রায় বলেন, ‘কিছুদিন ধরে একই স্কুলের কয়েক ছেলে আমার বোনকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। ঘটনার দিন সকালে কোচিং শেষে ফেরার পথে ওই ছেলেরা আবার উত্ত্যক্ত করে। তাদের নিষেধ করলে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে তারা আমার বোনকে ধাওয়া করে। ওদের ধাওয়ায় বোন বাসায় এসে মায়ের কাছ থেকে তার ফোন নিয়ে এক বান্ধবীকে কল দেয়। কিন্তু সে ফোন কল রিসিভ করেনি। এরপরই সে ঘরের ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকে ফাঁস দেয়। ঘটনায় জড়িত বখাটেদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘প্রথমে পুলিশ মামলটি নেয় না। তারা বলে মামলা করার দরকার নেই। তোমার বোন টিকটক করতে বাধা দেওয়ায় মারা গেছে। পরে বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ ও মানববন্ধন করার পরে পুলিশ মামলা নিয়েছে। তবে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশের ছেলে আরাফাত রহমান খানের নাম এজাহারে যোগ করলেও পুলিশ সেই নামটা বাদ দিয়ে এজাহার নিয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও এই মামলার করার বিষয়ে অসহযোগিতা করেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করছেন প্রধান শিক্ষক আবদুস সামাদ। তিনি বলছেন, অভিযুক্তদের শনাক্তে তিনি সহযোগিতা করেছেন। অনির মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। সৃুষ্ঠু তদন্ত শেষে এই ঘটনার আমরাও বিচার চাই।
এদিকে, স্কুলের বাইরের দৃশ্য সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লেও স্কুলের ভিতরে আসলে কি ঘটেছিল সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে অনির সহপাঠী লামিয়া সুলতানা সেতু জানিয়েছেন, মেহেদী হাসান তামিমের সঙ্গে অনি রায়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ২৬ মার্চ অনি রায় ও তার বান্ধবীরা মিলে টিকটক তৈরি করেছিল। তার আরেক বান্ধবী সেটি টিকটকে আপলোড করেছিল। সেটি নিয়ে তামিমের সঙ্গে অনির মনোমালিন্য হয়। অনি রায় স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরেই ফোন করেছিল আরেক সহপাঠী সৈয়দ সুমাইয়া সিমরানের কাছে। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করেনি। এরপর আত্মহত্যা করে অনি। সেই বান্ধবী সিমরান বলছেন, ২৬ মার্চ অনির বাড়িতেই বান্ধবীরা মিলে টিকটক করা হয়। সেটি আপলোড করেছিলাম। তার মৃত্যুর পর ডিলেট করে দিয়েছি। কি কারণে সে আত্মহত্যা করেছে সেটা জানি না। তবে টিকটকের কারণে সে আত্মহত্যা করেনি। কারণ সেই টিকটকে তার মাও আমাদের সঙ্গে ছিলো। এই বিষয়ে ঝিকরগাছা থানার অফিসার ইনচার্জ সুমন ভক্ত বলেন, অনির আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে। অভিযুক্ত একজনকে আটকও করলে বিজ্ঞ আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ করেছে। বাকীদের গ্রেফতার ও এই মামলার রহস্য উদঘাটন তদন্ত চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাদীর দেয়া এজাহারই মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে, এখানে কোন কাটসার্ট করা হয়নি বলে দাবি করেছেন তিনি।